নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দাবানল। একই সঙ্গে গত কয়েক দিন ধরে চলা প্রচণ্ড বাতাসও কমতে শুরু করেছে। বাতাস কমায় দাবানলের বড় দুটি জায়গার আগুন শুক্রবার নিয়ন্ত্রণ আসতে শুরু করে। এতে আজ শনিবার পর্যন্ত প্রাণ গেছে ১১ জনের। ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে আরও দুই লাখ জনকে। খবর- বিবিসি।
লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র ক্যারেন বাস জানিয়েছেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে সাফল্যের খবর এসেছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ক্যালিফোর্নিয়া ফায়ার সার্ভিস বলেছে, শুক্রবারের আগ পর্যন্ত বড় দুই দাবানল প্যালিসেইডস ও ইটনে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার মাত্রা ছিল শূন্য শতাংশ। অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা আকাশ ও মাটি থেকে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালানোর পরও কয়েক দিন ধরে দাবানল ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। অবশেষে প্যালিসেইডসের আগুন ৮ শতাংশ এবং ইটনের আগুন তিন শতাংশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
পাঁচটি দাবানলের আগুন নেভাতে এখনো লড়াই করছেন অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা। ভয়াবহ এ দাবানলে লস অ্যাঞ্জেলেস মাইলের পর মাইল এলাকায় গাছপালা, বসতবাড়িসহ যাবতীয় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ১০ হাজারের বেশি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগময় এ পরিস্থিতিতে লুটতরাজে নেমেছে একদল দুর্বৃত্ত। তাদের ঠেকাতে কারফিউ জারির পরিকল্পনা করছে পুলিশ। শুষ্ক ও তীব্র বাতাস বইছে, যা আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুন এলাকায়। এরই মধ্যে এটি মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দাবানলের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে; আনুমানিক ক্ষতি ধরা হচ্ছে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার।
শুক্রবার ছিল এ দাবানলের চতুর্থ দিন। এদিন লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের পশ্চিম ও পূর্ব অংশে সব মিলিয়ে পাঁচটি দাবানল সক্রিয় দেখা গেছে। এরই মধ্যে লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক দাবানলের তকমা পেয়েছে এটি; ছড়িয়ে পড়েছে ৩৪ হাজার একরের বেশি এলাকায়। ৫৩ বর্গমাইল এলাকার বসতি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাতে লস অ্যাঞ্জেলেসের উপকূলীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। রয়টার্স জানায়, এ সময় যাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেক হলিউড তারকাও আছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ কর্মকর্তা রবার্ট লুনা জানান, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এসব এলাকায় যেন পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে। কোনো সুখবরের প্রত্যাশা নেই। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আকু-ওয়েদারের আনুমান, দাবানলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা ১৩৫ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের কম নয়। সংস্থাটির প্রধান আবহাওয়াবিদ জনাথন পর্টার বলেন, তীব্র বাতাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দাবনল ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যারাডাইজে যে দাবানল হয়েছিল, তাতে সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক সরকারের সমালোচনা করেছেন প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ রিপাবলিকান পার্টির নেতারা। বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ১৮০ দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনর্গঠন করবে। উদ্ধারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ‘আমাদের মার্কিন প্রতিবেশীর সহায়তায় কানাডা হাজির আছে।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকায় দাউদাউ আগুন জ্বলছে; আকাশে মেঘের মতো জমেছে ধোঁয়া। আকাশ থেকে ফেলা হচ্ছে পানি ও রাসায়নিক। এ ছাড়া আগুন নেভাতে সরাসরি কাজ করছেন বিপুল সংখ্যক কর্মী। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী শহর লস অ্যাঞ্জেলেসের কালাবাসাসের পাশে একটি নতুন দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উপগ্রহ থেকে তোলা ভিডিওতে দেখা গেছে, দাবানলগুলোর মধ্যে দুটি সবচেয়ে বিস্তৃত ও ভয়ানক। বিবিসি জানায়, দাবানল দ্য প্যালিসেডস ও ইটন ফায়ারস ৩৪ হাজার একর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এ দুটি দাবানলের সূত্রপাত হয় মঙ্গলবার।
আগুনের ভয়াবহতার কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে রয়েছে প্যাসিফিক প্যালিসেডস। সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে; রাস্তায় পড়ে আছে পোড়া গাড়ির সারি। ওই এলাকার বাসিন্দা ৬৫ বছরের জন কার জানান, সরে যেতে দেওয়া সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে তিনি বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। পরে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘বাড়িটি আমার মা-বাবা তৈরি করেছিলেন ১৯৬০ সালে। আমার পুরো জীবন আমি এখানে কাটিয়েছি। এখানে অনেক স্মৃতি আমার।’
দ্য গার্ডিয়ান অনলাইন জানায়, শুক্রবার লস অ্যাঞ্জেলেসের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ হিসেবে ব্যাপক ধোঁয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব এলাকায় দাবানল ছড়িয়ে পড়েনি, সেখানেও ছড়িয়েছে ধোঁয়া। এরই মধ্যে লস অ্যাঞ্জেলেসে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গার্ডের সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ চালাচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত। এর জেরে অন্তত ২০ জনকে আটক করা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির পুলিশপ্রধান রবার্ট লুনা নৈশকালীন কারফিউ জারির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। তবে এরই মধ্যে সান্তা মনিকা শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। দাবানল প্রসঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র ক্যারেন ব্যাস বলেন, ‘এটা নজিরবিহীন ও ঐতিহাসিক অগ্নিঝড়। তবে আমরা একসঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়ছি।’
অগ্নিনির্বাপণ কর্মীদের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, গতকাল পর্যন্ত দ্য প্যালিসেডস সবচেয়ে বেশি ২০ হাজার একর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তারা এ আগুন নেভানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। ক্যালিফোর্নিয়ার বন ও অগ্নিসুরক্ষা বিভাগের প্রধান ব্রেন্ট পেসকুয়া বলেন, তারা গতকাল সকাল পর্যন্ত দ্য প্যালিসেডসের ৬ শতাংশ আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছেন।
দাবানলের স্বাস্থ্যঝুঁকিও মারত্মক বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা। ডা. জয়তি মিশ্র ব্যক্তিগতভাবে জানেন দাবানলের কারণে ঠিক কতটা ক্ষতি হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভাগের এ সহকারী অধ্যাপক এক জরিপের ভিত্তিতে জানান, যারা দাবানলের কারণে বাস্তুচ্যুত হন, তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, হাতাশা ও ট্রমা-উত্তর মানসিক চাপ দেখা যায়। দাবানল এমন ভয়ংকর হয়ে ওঠার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে কীভাবে এর সূত্রপাত হলো, তা সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে পারছেন না। ক্যালিফোর্নিয়া ফায়ার সার্ভিসের একটি ব্যাটালিয়নের প্রধান ডেভিভ অ্যাকুনার মতে, ক্যালিফোর্নিয়া এলাকার ৫ শতাংশ দাবানলের শুরুটা হয় মানুষের কারণেই। যদিও চলমান দাবানলের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল, তা এখনও স্পষ্ট করেননি সরকারি কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দীর্ঘ খরা ও তীব্র বাতাসের কারণে দাবানল দ্রুত ছড়াচ্ছে।
খুলনা গেজেট/এনএম
The post লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল নিয়ন্ত্রণে appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.