রাজনীতির অন্য সব ঘরানার চেয়ে জনতুষ্টিবাদীদের সবসময় দর্শকদের দরকার হয়। নজরকাড়া দাবি ও প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে নতুন জাতীয় পৌরাণিক গল্প তৈরি করে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়াই জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের লক্ষ্য। অন্যান্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও কম মতাদর্শিক বিনোদনদাতাদের চেয়ে তাদের কর্মকাণ্ডের দিকে মানুষের বেশি নজর থাকার পাশাপাশি তাদেরকে ওই কাজগুলো করতে মানুষ যেন বারবার অনুরোধ করে— এটাই তাদের চাওয়া। কারণ একটি সুগ্রাহী দর্শকসমাজ ছাড়া জনতুষ্টিবাদকে বহু বছর ধরে চলা অন্যান্য প্রান্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো নড়বড়ে ও সাদামাটা দেখাতে পারে।
ভারত, আর্জেন্টিনা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে বর্তমানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীদের মূল দর্শকশ্রেণিগুলোকে ধরে রাখার দায় ডানপন্থী গণমাধ্যমগুলোর। এ কারণে নিরবচ্ছিন্নভাবে জনতুষ্টিবাদের বার্তাগুলো সম্প্রচার করে এর প্রধান ব্যক্তিত্বদের এগিয়ে রাখা রক্ষণশীল ভাষ্যকার, সাংবাদিক এবং জনবুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রিফর্ম ইউকের মাত্র পাঁচজন সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও দলটির নেতা নাইজেল ফ্যারেজ যেভাবে টরি সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল; ঠিক একইভাবে টরি সংবাদমাধ্যমগুলোও তার ওপর নির্ভরশীল। ব্রিটেনে ডানপন্থী রাজনীতি বর্তমানে একপ্রকার নিম্নমুখী অবস্থায় রয়েছে। তবুও জনতুষ্টিবাদীদের বিরুদ্ধে কিংবা নিরপেক্ষভাবে কাজ করা এ সব সাংবাদিকের মাধ্যমে তারা লাভবান হচ্ছে।
ব্রেক্সিট গণভোটের প্রচারণার প্রথম থেকে এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌঁড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম সফলতা অর্জনের পর অন্তত এক দশক ধরে আটলান্টিকের পাড়ে জনতুষ্টিবাদের পুনরুত্থানে বিমোহিত হয়েছেন অনেক মধ্যপন্থী ও বাম ঘরানার রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
বিবিসি, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে শুরু করে নিউ স্টেটসম্যান এবং গার্ডিয়ানও অব্যাহতভাবে জনতুষ্টিবাদী ভোটারদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রাম্প, ফ্যারেজ ও ইলন মাস্কের প্রতি মুহূর্তের পোস্টগুলো এবং তাদের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
রিফর্ম ইউকে নির্বাচনে যখন লেবার ও কনজারভেটিভদের প্রায় ধরে ফেলেছে এবং ট্রাম্প আবার ক্ষমতা গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন, তখন বলা কঠিন যে এই কাভারেজ অযৌক্তিক ছিল। কিন্তু ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদবিরোধীদের জন্য এটি রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ফলে জনতুষ্টিবাদের প্রাধান্য এখন ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশের রাজনীতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা জলবায়ু সংকটের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আগ্রহ দমন করে মূলধারার দলগুলোকে ডানদিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এমনকি সবচেয়ে কট্টর জনতুষ্টিবাদীদেরও এখন গণমাধ্যমগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে বৈধ বা অপরিহার্য রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে— যা কখনোই অতি বামপন্থীদের ক্ষেত্রে করা হয় না। গত সপ্তাহে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযত বিবিসির ফোন-ইন হোস্টের প্রবীণ সাংবাদিক নিকি ক্যাম্পবেল ইলন মাস্ক রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করবেন কি না তা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। পাশাপাশি তাঁকে “পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি” বলেও অভিহিত করেন তিনি। এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ বর্ণনা নিঃসন্দেহে মাস্ককে উৎফুল্ল করবে।
জনতুষ্টিবাদ নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য উদারপন্থী সাংবাদিকদের আরও ভালো কিংবা কম ক্ষতিকর উপায় থাকতে পারে কি-না তা সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের বিষয়। প্রায়শই স্ববিরোধে পরিপূর্ণ, অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতির প্রতি আসক্ত এবং কার্যত শাসনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ বা অস্তিত্বহীন এই মতবাদ তদন্তের বহু ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
রিফর্ম ইউকের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারে “কর হ্রাস”, “আমাদের ভেঙে পড়া জনসেবা মেরামত”, “সমস্ত অপরাধ ও অসামাজিক আচরণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স” এবং “সরকারি অপচয় বন্ধ” করার মতো প্রতিশ্রুতি এর উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এমন বিশাল উচ্চাভিলাষী নীতিগুলোকে লেবার পার্টির আরও সংযত কর্মসূচির মতোই সন্দেহপ্রবণ প্রশ্নের মুখে ফেলা উচিত।
জনতুষ্টিবাদের উন্মত্ত গতি এবং নাটকীয় বক্তৃতা ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের নিরবচ্ছিন্ন বিষয়বস্তুর চাহিদার সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই হওয়ার অর্থ এই নয় যে প্রতিটি জনতুষ্টিবাদী উস্কানি, গর্ব বা হুমকির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রতিবেদন করতে হবে। তাই কখন জনতুষ্টিবাদীদের প্রচারণা করা উচিত, তা নিয়ে উদারপন্থী সাংবাদিকদের আরও চিন্তাশীল হওয়া প্রয়োজন।
মূলত, ট্রাম্প বা ফ্যারেজ যা কিছু করেছেন, তা ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপে ডানপন্থীদের উগ্র হয়ে উঠতে দেখা এমন কাউকে খুব একটা অবাক করবে না। তাই সাংবাদিকদের উচিত আজকের এই জনতুষ্টিবাদকে আরও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়ন করা। কেননা বিপজ্জনকভাবে সহজ সমাধানের প্রতি ভোটারদের আকাঙ্ক্ষাকে পরিচালিত করা এবং বিদেশি ও উদার অভিজাতদের বিষয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসীদের বলির পাঁঠা বানানোর মধ্য দিয়ে কূটকৌশলী নেতারা এর আগে পশ্চিমা রাজনীতিতে ক্যারিশমা দেখিয়েছেন। যার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।
সাংবাদিকতা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে ভুগছে, প্রায়শই এ কথা বলা হয়। যদি কথিত কঠোর সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানগুলো জনতুষ্টিবাদকে এতটাই বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে কাভার করতে থাকে, তবে এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বিশেষত, যদি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ততটাই বিপর্যয়কর হয়ে ওঠে, যতটা ধারণা করা হচ্ছে। এতে তাদের পক্ষে ভোটদাতারাও গণমাধ্যমের ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারেন জনতুষ্টিবাদীদের নিয়ে সঠিক প্রশ্নসমূহ না তোলার কারণে।
তবে গণমাধ্যমে জনতুষ্টিবাদের আধিপত্যের জন্য শুধু সাংবাদিকদের দোষারোপ করা একটি বড় ধরনের অস্বস্তিকর বাস্তবতা। কারণ যতক্ষণ না জনতুষ্টিবাদকে বিরক্তিকর মনে করতে শুরু করার পাশাপাশি এর আবেগপ্রবণতাগুলো ভোটারদের উদাস করে তুলে অন্য দিকে তাকাতে বাধ্য না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর উত্থান অব্যাহত থাকবে।
• অ্যান্ডি বেকেট, ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ
• দ্য গার্ডিয়ান থেকে ঈষৎ সংক্ষিপ্তাকারে ভাষান্তর: রুশাইদ আহমেদ
খুলনা গেজেট/এনএম
The post গণমাধ্যম কি জনতুষ্টিবাদকে বৈধতা দিচ্ছে? appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.
ঠিকানা : গুলশান, ঢাকা, বাংলাদেশ || তথ্য, খবর ও বিজ্ঞাপন : +8809611719385 || ইমেইল : songbadpatra24@gmail.com
Visit : songbadpatra.com
All rights reserved © সংবাদপত্র-2024