4:34 am, Wednesday, 15 January 2025

এমনিতেই গাছ কম, তারপরও চুরি হওয়ায় কমছে খেজুরের রস সংগ্রহ

এম,এইচ চুন্নু।।বিশেষ প্রতিনিধি:

দিন যায়, রাতে আসে আবার রাত যায় আসে দিন। এভাবেই দিনের পর দিন বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে কমছে খেজুরের গাছ। ফলে কমে যাচ্ছে খেজুরের রস সংগ্রহ। এমন পরিস্থিতিতেও কেউ কেউ ঐতিহ্য ধরে রাখতে বেঁচে থাকা গাছগুলো থেকে রস সংগ্রহ করেন। কিন্তু তাতেও আছে বিপত্তি, প্রতিদিনই কোনো না কোনো গাছ থেকে রস চুরি হয়। এতে কমছে সংগ্রহ। সরবরাহেও হচ্ছে সমস্যা। 

বরিশালে খেজুরের গাছ কমে যাওয়ার কারণ ইটভাটা। গাছিরা বলছেন, ইটভাটা বেড়ে যাওয়ায় তাদের খেজুরের রস সংগ্রহ করার পরিমাণও কমে গেছে। তা ছাড়া আরেক কারণ হচ্ছে হাড়িসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গের দাম বেড়ে যাওয়া। 

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার উদয়কাঠী এলাকার বাসিন্দা আলী হাওলাদার (৫৫)। যিনি তিন যুগের বেশি সময় ধরে শীতকালে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করছেন। তিনি জানান, আগে খেজুরের রস সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি, অথবা গুড় বানানোর কাজ বেশি করতেন। এখন গাছ কমে যাওয়ায় রস সংগ্রহ হয় অল্প। তাই গুর তৈরি না করে বাজারে বিক্রি করে দেন। 

আলী হাওলাদার বলেন, একযুগ আগেও গ্রামের বড় বড় বাড়িগুলোয় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। এক বাড়ি থেকেই ২০-৩০ লিটার খেজুর রস সংগ্রহ করা যেত। তখন একদিন গাছ মালিককে রস দিয়ে একদিন গাছি নিতো। এখন পাঁচ বাড়ি ঘুরেও ২০টি খেজুর গাছ পাওয়া যায় না। গাছ মালিককেও তিনভাগের একভাগ দিয়েও শ্রমের মজুরি তোলা যায় না। শুধু ইটভাটার জ্বালানির জন্য খেজুর গাছসহ গ্রামের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সংখ্যা কমেছে। নতুন করে আম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ অন্যান্য ফলের গাছ লাগালেও এখন কেউ খেজুর গাছ রোপণ করতে চায় না। ফলে এ অঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা কমছেই।

তবে শুধু গাছ কমে যাওয়া নয়, চুরি ও হাড়িসহ প্রয়োজনীয় মালামালের দাম বৃদ্ধির কারণেও শীতে রস সংগ্রহে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বাসিন্দা ও গাছি আলমগীর হোসেন হাওলাদার। তিনি বলেন, ২০-২৫ বছর ধরে অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে খেজুর গাছ বাছাইয়ের কাজটি শুরু করেন। এরপর গাছের বাকল ছিলে রস সংগ্রহ শুরু করেন। তবে আগের মতো এখন খেজুর গাছ নেই। গাছ না থাকার পাশাপাশি রস চুরি, হাড়িসহ প্রয়োজনীয় মালামালের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন তেমন কেউ এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। আগে প্রচুর গাছ থাকলেও এখনকার মতো রস চুরি হতো না। এখন রাস্তার পাশের গাছে হাঁড়ি ঝোলালেই সেটি রসসহ চুরি হয়ে যায়। 

এতে করে আর্থিক লোকসান হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গাছ মালিকের ভাগের রস দিতে হয় এটাই নিয়ম, তার ওপর চুরি হলে সে লোকসানও গাছির হয়। তাই সড়কের পাশ থেকে বাড়ির ভেতরের গাছ হলে তা থেকে রস সংগ্রহ নিরাপদ। তবে সেই রস সংগ্রহেও গাছের নিচে কাটা দিয়ে রাখতে হয়। আবার রসের হাঁড়িতে যাতে বাদুড় মুখ না দেয় সেজন্য নেট বা মশারির কাপড় দিয়ে দিতে হয়। এতকিছু করে রস সংগ্রহের কাজে কারও আগ্রহ দেখা যায় না। আমি এখন শখের বসে রস সংগ্রহ করি। প্রতিদিন বিকেলে হাড়ি গাছে ঝুলিয়ে দিই, ভোরে নামিয়ে বাজারে নিয়ে যাই।

আগে হাড়ি প্রতি রস বিক্রি হলেও এখন লিটার প্রতি ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, রসের মূল্য আর সরবরাহ কমের কারণে এখন গুড় তৈরি কমে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাঁচা রস খোলা বাজারে লিটার প্রতি বিক্রি হয়। তবে সেই রসেরও চাহিদা অনেক। কারণ, কাঁচা রস খাওয়ার চেয়ে এই সময়য়ে রসে ভেজানো পিঠার কদর থাকে বেশি। 

নানা কারণে খেজুর রস সংগ্রহ কমে গেছে এমন কথা জানালেন গ্রামের সাধারণ মানুষও। বরিশাল শহরতলীর বাসিন্দা সীমা বেগম বলেন, ছোট বেলায় শীতের সময় প্রতিদিন বাড়ির উঠানে চাচাদের দেখতাম রসের হাঁড়ি গাছ থেকে নামিয়ে এক জায়গা করতেন। তারপর সেই রস ছেঁকে আমাদের খেতে দিতেন। বাকিটা হয় গুড় বানাতে বিশাল চুলায় ওঠাতেন, নয়তো রসের পিঠার জন্য রাখতেন। আর যেদিন পিঠা বানানো হতো সেদিন তো গোটা বাড়িতে মেলা বসে যেত। 

তিনি বলেন, এখন নিজের সন্তানদের খেজুর রস দেখাতে হলে দুদিন আগে স্থানীয় হাটে খোঁজ রাখতে হয়। তারপর চড়া দামে সেগুলো কিনে এনে রসের পিঠা খাওয়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ গুড় বানাতে যে রস প্রয়োজন তা গোটা হাটে একদিনে মেলে না। তার ওপর নিপা ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে কাঁচা রস সন্তানদের খেতেও দিতে পারি না।

The post এমনিতেই গাছ কম, তারপরও চুরি হওয়ায় কমছে খেজুরের রস সংগ্রহ appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.

Tag :

এমনিতেই গাছ কম, তারপরও চুরি হওয়ায় কমছে খেজুরের রস সংগ্রহ

Update Time : 11:08:48 am, Tuesday, 14 January 2025

এম,এইচ চুন্নু।।বিশেষ প্রতিনিধি:

দিন যায়, রাতে আসে আবার রাত যায় আসে দিন। এভাবেই দিনের পর দিন বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে কমছে খেজুরের গাছ। ফলে কমে যাচ্ছে খেজুরের রস সংগ্রহ। এমন পরিস্থিতিতেও কেউ কেউ ঐতিহ্য ধরে রাখতে বেঁচে থাকা গাছগুলো থেকে রস সংগ্রহ করেন। কিন্তু তাতেও আছে বিপত্তি, প্রতিদিনই কোনো না কোনো গাছ থেকে রস চুরি হয়। এতে কমছে সংগ্রহ। সরবরাহেও হচ্ছে সমস্যা। 

বরিশালে খেজুরের গাছ কমে যাওয়ার কারণ ইটভাটা। গাছিরা বলছেন, ইটভাটা বেড়ে যাওয়ায় তাদের খেজুরের রস সংগ্রহ করার পরিমাণও কমে গেছে। তা ছাড়া আরেক কারণ হচ্ছে হাড়িসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গের দাম বেড়ে যাওয়া। 

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার উদয়কাঠী এলাকার বাসিন্দা আলী হাওলাদার (৫৫)। যিনি তিন যুগের বেশি সময় ধরে শীতকালে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করছেন। তিনি জানান, আগে খেজুরের রস সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি, অথবা গুড় বানানোর কাজ বেশি করতেন। এখন গাছ কমে যাওয়ায় রস সংগ্রহ হয় অল্প। তাই গুর তৈরি না করে বাজারে বিক্রি করে দেন। 

আলী হাওলাদার বলেন, একযুগ আগেও গ্রামের বড় বড় বাড়িগুলোয় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। এক বাড়ি থেকেই ২০-৩০ লিটার খেজুর রস সংগ্রহ করা যেত। তখন একদিন গাছ মালিককে রস দিয়ে একদিন গাছি নিতো। এখন পাঁচ বাড়ি ঘুরেও ২০টি খেজুর গাছ পাওয়া যায় না। গাছ মালিককেও তিনভাগের একভাগ দিয়েও শ্রমের মজুরি তোলা যায় না। শুধু ইটভাটার জ্বালানির জন্য খেজুর গাছসহ গ্রামের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সংখ্যা কমেছে। নতুন করে আম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ অন্যান্য ফলের গাছ লাগালেও এখন কেউ খেজুর গাছ রোপণ করতে চায় না। ফলে এ অঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা কমছেই।

তবে শুধু গাছ কমে যাওয়া নয়, চুরি ও হাড়িসহ প্রয়োজনীয় মালামালের দাম বৃদ্ধির কারণেও শীতে রস সংগ্রহে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বাসিন্দা ও গাছি আলমগীর হোসেন হাওলাদার। তিনি বলেন, ২০-২৫ বছর ধরে অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে খেজুর গাছ বাছাইয়ের কাজটি শুরু করেন। এরপর গাছের বাকল ছিলে রস সংগ্রহ শুরু করেন। তবে আগের মতো এখন খেজুর গাছ নেই। গাছ না থাকার পাশাপাশি রস চুরি, হাড়িসহ প্রয়োজনীয় মালামালের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন তেমন কেউ এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। আগে প্রচুর গাছ থাকলেও এখনকার মতো রস চুরি হতো না। এখন রাস্তার পাশের গাছে হাঁড়ি ঝোলালেই সেটি রসসহ চুরি হয়ে যায়। 

এতে করে আর্থিক লোকসান হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গাছ মালিকের ভাগের রস দিতে হয় এটাই নিয়ম, তার ওপর চুরি হলে সে লোকসানও গাছির হয়। তাই সড়কের পাশ থেকে বাড়ির ভেতরের গাছ হলে তা থেকে রস সংগ্রহ নিরাপদ। তবে সেই রস সংগ্রহেও গাছের নিচে কাটা দিয়ে রাখতে হয়। আবার রসের হাঁড়িতে যাতে বাদুড় মুখ না দেয় সেজন্য নেট বা মশারির কাপড় দিয়ে দিতে হয়। এতকিছু করে রস সংগ্রহের কাজে কারও আগ্রহ দেখা যায় না। আমি এখন শখের বসে রস সংগ্রহ করি। প্রতিদিন বিকেলে হাড়ি গাছে ঝুলিয়ে দিই, ভোরে নামিয়ে বাজারে নিয়ে যাই।

আগে হাড়ি প্রতি রস বিক্রি হলেও এখন লিটার প্রতি ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, রসের মূল্য আর সরবরাহ কমের কারণে এখন গুড় তৈরি কমে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাঁচা রস খোলা বাজারে লিটার প্রতি বিক্রি হয়। তবে সেই রসেরও চাহিদা অনেক। কারণ, কাঁচা রস খাওয়ার চেয়ে এই সময়য়ে রসে ভেজানো পিঠার কদর থাকে বেশি। 

নানা কারণে খেজুর রস সংগ্রহ কমে গেছে এমন কথা জানালেন গ্রামের সাধারণ মানুষও। বরিশাল শহরতলীর বাসিন্দা সীমা বেগম বলেন, ছোট বেলায় শীতের সময় প্রতিদিন বাড়ির উঠানে চাচাদের দেখতাম রসের হাঁড়ি গাছ থেকে নামিয়ে এক জায়গা করতেন। তারপর সেই রস ছেঁকে আমাদের খেতে দিতেন। বাকিটা হয় গুড় বানাতে বিশাল চুলায় ওঠাতেন, নয়তো রসের পিঠার জন্য রাখতেন। আর যেদিন পিঠা বানানো হতো সেদিন তো গোটা বাড়িতে মেলা বসে যেত। 

তিনি বলেন, এখন নিজের সন্তানদের খেজুর রস দেখাতে হলে দুদিন আগে স্থানীয় হাটে খোঁজ রাখতে হয়। তারপর চড়া দামে সেগুলো কিনে এনে রসের পিঠা খাওয়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ গুড় বানাতে যে রস প্রয়োজন তা গোটা হাটে একদিনে মেলে না। তার ওপর নিপা ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে কাঁচা রস সন্তানদের খেতেও দিতে পারি না।

The post এমনিতেই গাছ কম, তারপরও চুরি হওয়ায় কমছে খেজুরের রস সংগ্রহ appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.