বহুমাত্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি আর আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগের মুখে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রীর পদ থেকে অবশেষে ইস্তফা দিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। মঙ্গলবার তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। টিউলিপের খালা ও বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কের বিষয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠায় তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
টিউলিপ দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই আলোচনায় ছিলেন ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এই মন্ত্রী। বিশেষ করে কয়েক সপ্তাহ ধরে টিউলিপ ইস্যুতে সরগরম প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ডাউনিং স্ট্রিট। আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠায় আলোচনা ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে কয়েকজন প্রার্থীর সংক্ষিপ্ত তালিকাও তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর।
যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপর চাপ বাড়ছিল। মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে বরখাস্ত করতে স্টারমারকে চাপ দিচ্ছিলেন বিরোধীরা। সর্বশেষ গতকালও দেশটির দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনের জোট ‘ইউকে অ্যান্টি-করাপশন কোয়ালিশন’ তাঁকে পদত্যাগের আহ্বান জানায়। তবে ৪২ বছর বয়সী এ মন্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। দুই মাসের মধ্যে সরকারের দ্বিতীয় মন্ত্রীর পদত্যাগ স্টারমারের জন্যও একটি ধাক্কা। গত সপ্তাহেও তিনি টিউলিপের ওপর পূর্ণ আস্থা থাকার কথা জানিয়েছিলেন।
পদত্যাগপত্রে প্রধানমন্ত্রী আস্থা রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন টিউলিপ। তিনি লেখেন, আমার অনুরোধে আমার বিরুদ্ধে গভীর পর্যালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীন উপদেষ্টা লাউরি ম্যাগনাস। পর্যালোচনা করে তিনি নিশ্চিত করেন যে আমি অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রিত্বের কোনো নিয়মনীতি লঙ্ঘন করিনি। তিনি এটাও জানান, আমার বিরুদ্ধে নিজের বাড়ি ও যেখানে বসবাস করি সে সম্পত্তিতে অন্যায়ভাবে ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
টিউলিপ বলেন, আমি মন্ত্রী হওয়ার পর আমার সম্পূর্ণ তথ্য সরকারকে দিয়েছি। আমার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী– তা বিস্তারিত আলোচনার পর স্বার্থের সংঘাত এড়াতে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিষয়াদি আমার কর্মকর্তারা আমাকে এড়িয়ে চলতে বলেন। আমি আপনাকে এতটুকু নিশ্চিত করতে চাই যে, আমি সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে আগেও কাজ করেছি এবং ভবিষ্যতেও কাজ করব। তবে এটি পরিষ্কার যে, মন্ত্রী হিসেবে আমার কাজ চালিয়ে যাওয়া সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আমার সমর্থন সবসময় লেবার পার্টির সরকারের সঙ্গে থাকবে। আমি মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পেছন থেকে আমি সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাব।
গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ইন্ডিপেন্ডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজার স্যার লাউরি ম্যাগনাসের কাছে হাজির হয়ে টিউলিপ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি কোনো ভুল করিনি।’
এর আগে যুক্তরাজ্যের দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনের জোট জানায়, ‘আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ও যুক্তরাজ্যের সুনাম রক্ষায় সরকারের পক্ষে অনেক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ টিউলিপের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কারণে সৃষ্ট স্বার্থ-সংঘাতে এটি এখন স্পষ্ট নয়– তিনি এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কিনা। তিনি মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ও অর্থনৈতিক অপরাধ মোকাবিলার দায়িত্বে আছেন। অথচ তাঁর সরাসরি পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে একটি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সঙ্গে, যা ওই কাঠামোর অধীনে তদন্তের মুখোমুখি হতে পারে। এই স্বার্থ-সংঘাত তদন্তের ফলাফল যাই হোক না কেন, তা বহাল থাকে।’
আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং হাসিনা প্রশাসনের সদস্য ও সংগঠনের সম্পদ জব্দ প্রশ্নে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় জোটটি। পাশাপাশি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সদস্য ও সহযোগীদের সম্পদের সন্দেহজনক গতিবিধির জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করতেও ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বিরোধী দল কনজারভেটিভরা টিউলিপকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। আবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তদন্তে যদি প্রমাণ হয় টিউলিপ এসব ‘ডাকাতি’র সুবিধাভোগী, তাহলে সম্পত্তিগুলো ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।’ টিউলিপকে ঘিরে তৈরি হওয়া এই কেলেঙ্কারি নিয়ে ড. ইউনূসের মন্তব্যের পর তাঁর ওপর পদত্যাগের চাপ আরও বেড়ে যায়।
টিউলিপের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পানামা পেপারসে কেলেঙ্কারিতে নাম থাকা একটি অফশোর কোম্পানি কিনেছিল, এমন একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন বাস করেছেন টিউলিপ। বাড়িটি লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এলাকায়। ওই অফশোর কোম্পানির সঙ্গে দু’জন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর যুক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া টিউলিপ ও তাঁর পরিবার লন্ডনে আওয়ামী লীগের সদস্য বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেনা পাঁচটি সম্পত্তি বিনামূল্যে পেয়েছেন বা ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প থেকে টিউলিপের পরিবার ৩৯০ কোটি পাউন্ড (৫৮ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা) পর্যন্ত অর্থ আত্মসাৎ করার যে অভিযোগ উঠেছে, সে-সংক্রান্ত তদন্তেও তাঁর নাম এসেছে।
অন্য একটি বিষয়েও প্রশ্নের মুখে পড়েন টিউলিপ। লন্ডনে বাংলাদেশি আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমান সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করেছিল চ্যানেল ফোর। বাংলাদেশের এক বিরোধী রাজনীতিকের আইনি দলে থাকাকালে ২০১৬ সালে তাঁকে গুম করা হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারটি টিভিতে প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগে র্যা বের সদস্যরা ঢাকায় আরমানের বাড়িতে অভিযান চালায় এবং তাঁর স্ত্রীকে হুমকি দেয়। গত বছর হাসিনার পতনের পর মুক্তি পান ব্যারিস্টার আরমান।
ইতোমধ্যে টিউলিপ ও তাঁর পরিবারের সাত সদস্যের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। পাশাপাশি, রুশ অর্থায়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি পূর্বাচল নিউ টাউনের প্লট বরাদ্দে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অনিয়মের মাধ্যমে প্লট নেওয়ার অভিযোগে টিউলিপসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেছে দুদক।
গণভবনে টিউলিপের প্রচারপত্র
সম্প্রতি দ্য টাইমসের এক সাংবাদিক বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি আবাস গণভবনে ঢোকার সুযোগ পান। সেখানে তিনি টিউলিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কিছু জিনিস এখনও পড়ে থাকতে দেখেন। টিউলিপের প্রচারপত্র, লেবার পার্টির পোস্টার, নামি ব্র্যান্ডের শপিং ব্যাগ, দামি কলমের মোড়ক, বিদেশি বিশিষ্টজনের উপহার দেওয়া পোশাক-গহনা, তৈজসপত্রসহ আরও নানা জিনিস এখানে-সেখানে পড়ে থাকতে দেখেন ওই সাংবাদিক।
খুলনা গেজেট/এইচ
The post পদত্যাগপত্রে যা লিখলেন টিউলিপ সিদ্দিক appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.
ঠিকানা : গুলশান, ঢাকা, বাংলাদেশ || তথ্য, খবর ও বিজ্ঞাপন : +8809611719385 || ইমেইল : songbadpatra24@gmail.com
Visit : songbadpatra.com
All rights reserved © সংবাদপত্র-2024