11:09 am, Saturday, 18 January 2025

চুক্তির জালে বন্দি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বইতে হবে দুই যুগ

এ যেন ঘোড়ার আগেই লাগাম কেনা। চাহিদা না বাড়লেও একের পর এক গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন না করেও ব্যবসায়ীরা পেয়ে গেছেন টাকা। জনগণের টাকার এমন শ্রাদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে। এ সময়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এতেই শেষ নয়; অসম চুক্তি, ভুল নীতি ও অনিয়মের কারণে আরও দুই যুগের বেশি সময় দেশবাসীকে টানতে হবে ঘানি।

বর্তমানে চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি। বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের চুক্তি খতিয়ে দেখতে জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার এই চক্র থেকে সহসাই মুক্তি মিলবে না।

বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট। দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে গরমে– এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে।
বিদ্যুৎ বিভাগ গত বছর গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরেছিল ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। তবে এখন পর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এ বছরের গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা যদি ১৮ হাজার মেগাওয়াট ধরা হয়, তাহলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এর চেয়ে ৯ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট বেশি। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি।

রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের বিবেচনায় চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা বেশি থাকতে হয়। একে রিজার্ভ মার্জিন বলে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে রিজার্ভ মার্জিন হিসাবে চাহিদার ২০ শতাংশ বেশি থাকা উচিত। সে হিসেবে বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা হওয়ার কথা ২১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট।

পিডিবির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, রিজার্ভ মার্জিন ২০ শতাংশের আশপাশে থাকা ভালো। এর বেশি হলে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দিতে হবে। আর কম হলে লোডশেডিং হবে।

যেভাবে মুনাফা লুটেছে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা

আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে ডজনখানেক কোম্পানি ফুলেফেঁপে উঠেছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তাঁর অফিস থেকেই তাঁর নির্দেশনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দেওয়া হতো পছন্দের কোম্পানিকে। বিশেষ আইনের সুযোগ নিয়ে টেন্ডার ছাড়াই নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে চুক্তি সই হতো, প্রয়োজন না থাকলেও মেয়াদ বাড়ানো হতো।

এমন সুবিধা পাওয়া কেন্দ্রগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। তাদের ঘোড়াশাল ১৪৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ২০১০ সালের আগস্টে উৎপাদনে আসে। কেন্দ্রটির জন্য এগ্রিকোর বিনিয়োগ ছিল ৫৬০ কোটি টাকা। তিন বছর মেয়াদি কেন্দ্রটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চালানো হয়। এই আট বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, যা বিনিয়োগের প্রায় সাড়ে চার গুণ। এভাবেই বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে কমিশন বাণিজ্য হয়েছে। এর মাধ্যমে ৩০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে। বিনা দরপত্রে চুক্তি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকবার চুক্তি নবায়নের সময়ও তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আমলা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠতা ব্যবসায়ীদের সুবিধাজনক (বাড়তি) দর, শর্ত ইত্যাদি আদায়ের সুযোগ করে দিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এ ধরনের চুক্তি সম্ভব নয়।

বেশির ভাগ কেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি

পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান বলছে, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়েছে। যদিও এ সময় বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। কিছু কিছু কেন্দ্র বছরে সক্ষমতার ২-৩ শতাংশ উৎপাদন করেছে। তবে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হবে, এমন শর্তেই চুক্তির সময় ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়।

২০০৯-১০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে ৮ হাজার ৪১১ মেগাওয়াট হয়। চলেছিল সক্ষমতার ৪২ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ অস্বাভাবিক বাড়তে থাকে। ২০২২-২৩-এ বেসরকারি কেন্দ্রের সক্ষমতা হয় ১২ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট।

উৎপাদনে ছিল সক্ষমতার ৪৫ শতাংশ, ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছর বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা হয় ১৬ হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট, ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য খরচ হয় ২৭ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। হুট করে ক্যাপাসিটি চার্জ দ্বিগুণ হওয়ার কারণ আদানি, পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী, এস আলমসহ বড় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো চালু হলেও দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা সেভাবে বাড়েনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের সক্ষমতার মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয়।

ভারতের ব্যবসায়ীরাও সুবিধা পেয়েছে

২০১৩ সাল থেকে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করা হয়। এখন সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। আদানির বিদ্যুৎ বাদে ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে আমদানির পরিমাণ ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ কিনতে গত ১১ বছরে খরচ হয়েছে ৪১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৬ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিগুলোর কয়েকটির মেয়াদ ২০৩৩ ও একটির ২০৩৯ সালের দিকে শেষ হবে।

আছে আরও বিভিন্ন দেশের কোম্পানি

আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশের কোম্পানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০২ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ২৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের ঘোড়াশাল কেন্দ্রসহ সাতটি কেন্দ্রের সক্ষমতা ছিল ৪৮০ মেগাওয়াট। ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে মোট খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। সিডিসি মালয়েশিয়া ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ২ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এই কেন্দ্রটি প্রায় সময়ই বন্ধ থাকত। শ্রীলঙ্কার কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনইপিসি কনসোর্টিয়াম ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। ভারতীয় শাপুরজি পালনজি এক বছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা।

 

খুলনা গেজেট/এইচ

The post চুক্তির জালে বন্দি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বইতে হবে দুই যুগ appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.

Tag :

চুক্তির জালে বন্দি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বইতে হবে দুই যুগ

Update Time : 08:08:04 am, Saturday, 18 January 2025

এ যেন ঘোড়ার আগেই লাগাম কেনা। চাহিদা না বাড়লেও একের পর এক গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন না করেও ব্যবসায়ীরা পেয়ে গেছেন টাকা। জনগণের টাকার এমন শ্রাদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে। এ সময়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এতেই শেষ নয়; অসম চুক্তি, ভুল নীতি ও অনিয়মের কারণে আরও দুই যুগের বেশি সময় দেশবাসীকে টানতে হবে ঘানি।

বর্তমানে চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি। বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের চুক্তি খতিয়ে দেখতে জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার এই চক্র থেকে সহসাই মুক্তি মিলবে না।

বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট। দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে গরমে– এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে।
বিদ্যুৎ বিভাগ গত বছর গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরেছিল ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। তবে এখন পর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এ বছরের গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা যদি ১৮ হাজার মেগাওয়াট ধরা হয়, তাহলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এর চেয়ে ৯ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট বেশি। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি।

রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের বিবেচনায় চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা বেশি থাকতে হয়। একে রিজার্ভ মার্জিন বলে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে রিজার্ভ মার্জিন হিসাবে চাহিদার ২০ শতাংশ বেশি থাকা উচিত। সে হিসেবে বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা হওয়ার কথা ২১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট।

পিডিবির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, রিজার্ভ মার্জিন ২০ শতাংশের আশপাশে থাকা ভালো। এর বেশি হলে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দিতে হবে। আর কম হলে লোডশেডিং হবে।

যেভাবে মুনাফা লুটেছে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা

আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে ডজনখানেক কোম্পানি ফুলেফেঁপে উঠেছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তাঁর অফিস থেকেই তাঁর নির্দেশনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দেওয়া হতো পছন্দের কোম্পানিকে। বিশেষ আইনের সুযোগ নিয়ে টেন্ডার ছাড়াই নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে চুক্তি সই হতো, প্রয়োজন না থাকলেও মেয়াদ বাড়ানো হতো।

এমন সুবিধা পাওয়া কেন্দ্রগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। তাদের ঘোড়াশাল ১৪৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ২০১০ সালের আগস্টে উৎপাদনে আসে। কেন্দ্রটির জন্য এগ্রিকোর বিনিয়োগ ছিল ৫৬০ কোটি টাকা। তিন বছর মেয়াদি কেন্দ্রটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চালানো হয়। এই আট বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, যা বিনিয়োগের প্রায় সাড়ে চার গুণ। এভাবেই বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে কমিশন বাণিজ্য হয়েছে। এর মাধ্যমে ৩০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে। বিনা দরপত্রে চুক্তি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকবার চুক্তি নবায়নের সময়ও তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আমলা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠতা ব্যবসায়ীদের সুবিধাজনক (বাড়তি) দর, শর্ত ইত্যাদি আদায়ের সুযোগ করে দিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এ ধরনের চুক্তি সম্ভব নয়।

বেশির ভাগ কেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি

পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান বলছে, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়েছে। যদিও এ সময় বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। কিছু কিছু কেন্দ্র বছরে সক্ষমতার ২-৩ শতাংশ উৎপাদন করেছে। তবে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হবে, এমন শর্তেই চুক্তির সময় ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়।

২০০৯-১০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে ৮ হাজার ৪১১ মেগাওয়াট হয়। চলেছিল সক্ষমতার ৪২ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ অস্বাভাবিক বাড়তে থাকে। ২০২২-২৩-এ বেসরকারি কেন্দ্রের সক্ষমতা হয় ১২ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট।

উৎপাদনে ছিল সক্ষমতার ৪৫ শতাংশ, ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছর বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা হয় ১৬ হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট, ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য খরচ হয় ২৭ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। হুট করে ক্যাপাসিটি চার্জ দ্বিগুণ হওয়ার কারণ আদানি, পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী, এস আলমসহ বড় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো চালু হলেও দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা সেভাবে বাড়েনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের সক্ষমতার মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয়।

ভারতের ব্যবসায়ীরাও সুবিধা পেয়েছে

২০১৩ সাল থেকে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করা হয়। এখন সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। আদানির বিদ্যুৎ বাদে ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে আমদানির পরিমাণ ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ কিনতে গত ১১ বছরে খরচ হয়েছে ৪১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৬ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিগুলোর কয়েকটির মেয়াদ ২০৩৩ ও একটির ২০৩৯ সালের দিকে শেষ হবে।

আছে আরও বিভিন্ন দেশের কোম্পানি

আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশের কোম্পানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০২ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ২৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের ঘোড়াশাল কেন্দ্রসহ সাতটি কেন্দ্রের সক্ষমতা ছিল ৪৮০ মেগাওয়াট। ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে মোট খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। সিডিসি মালয়েশিয়া ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ২ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এই কেন্দ্রটি প্রায় সময়ই বন্ধ থাকত। শ্রীলঙ্কার কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনইপিসি কনসোর্টিয়াম ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। ভারতীয় শাপুরজি পালনজি এক বছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা।

 

খুলনা গেজেট/এইচ

The post চুক্তির জালে বন্দি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বইতে হবে দুই যুগ appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.