প্রণোদনার ঘর ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের হিড়িক
বিশেষ প্রতিনিধি:
পটুয়াখালীর পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় রাখাইনদের মগনসম্পত্তিতে সরকারের দেয়া প্রণোদনার ঘর ভেঙে ফেলাহচ্ছে। কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াইনির্মাণকাজ চলছে একাধিক বহুতল ভবনের। এতে হুমকিরমুখে পড়েছে কুয়াকাটার অলংকার খ্যাত রাখাইনভাষা-শিক্ষাসহ ২৩০ বছরের পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাখাইনদের কাউকে কাউকে হাত করে এবং শেয়ারে প্রলুব্ধ করে কুয়াকাটার কেরানীপাড়ায় বহুতল ভবন নির্মাণ পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা।
আদিবাসী রাখাইনদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যসম্পৃক্ত কুয়াকাটা কেরানীপাড়া। পর্যটকদের কাছে বিশেষএক আকর্ষণ রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র। প্রতিদিন শতশত পর্যটক কেরানীপাড়া দেখতে আসেন।
জানা যায়, ১৭৯৪ সালে ১ লাখের বেশি রাখাইনের আগমন ঘটে পটুয়াখালীর উপকূল অঞ্চলে। সমুদ্রোপকূলকেন্দ্রিক বনাঞ্চল সাফ করে হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে রক্ষাপেতে টংয়ের ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেন তারা।
বন্য প্রাণীর সঙ্গে লড়ে বেড়ে ওঠা এই রাখাইন জাতি-গোষ্ঠীকুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের জঙ্গল কেটে প্রথমে আবাদিজমির আত্মপ্রকাশ ঘটান বলে তাদের দাবি। তবে বর্তমানেকুয়াকাটা উপকূল এলাকার পার্শ্ববর্তী অন্যান্য পাড়ার আদিবসতিতে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও কেরানীপাড়াএখন পুরোপুরিভাবে দূরে সরে যাচ্ছে তাদের আদি সংস্কৃতিটংয়ের ঘর থেকে। তোলা হচ্ছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন।
সরেজমিন জানা যায়, খালেদা জিয়ার সরকারের সময়কেরানীপাড়ায় রাখাইনদের উন্নত জীবনব্যবস্থার জন্য দেয়াহয় প্রণোদনার ঘর। এসব ঘর ভেঙে চলছে বহুতল ভবননির্মাণ। যেসব ঘর এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো নিয়েও পরিকল্পনা করছে বহুতল ভবন নির্মাণের। আর তাতে অচিরেই কুয়াকাটায় রাখাইনদের অস্তিত্ব বিলীনের আশঙ্কাকরছে সচেতন মহল।
রাখাইন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য টিকিয়েরাখতে সরকারের তরফ থেকে যেখানে নেয়া হচ্ছে নানাপদক্ষেপ, সেখানে শেয়ারের নামে নির্মাণযজ্ঞ চলছে অসংখ্যবহুতল বাণিজ্যিক ভবন। এ নিয়ে রাখাইনদের একাংশ, স্থানীয় বাসিন্দা এবং সচেতন মহলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভেরসৃষ্টি হয়েছে।
রাখাইনদের অভিযোগ, কালের বিবর্তনে নানাপ্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে অনেক রাখাইন ইতোমধ্যেকুয়াকাটা উপকূল অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখনমাত্র কয়েক হাজার রাখাইন এ অঞ্চলে টিকে আছে। যেসবরাখাইন উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করছে তারাও নানাহুমকির মধ্যে রয়েছে।
কুয়াকাটা কেরানীপাড়ার রাখাইনদের ভাষ্যমতে, কেরানীপাড়ার আওতাধীন জমির দখল নিতে স্থানীয়বিনিয়োগকারীরা কতিপয় লোভী রাখাইনের সাথে মিলেদীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এভাবে চলতেথাকলে অচিরেই ২৩০ বছরের সংস্কৃতি-ইতিহাস বহন করাকুয়াকাটার রাখাইন সম্প্রদায়সহ কেরানীপাড়া নিশ্চিহ্ন হয়েযাবে।
তারা আরও বলছেন, প্রতিদিন শত শত পর্যটক কেরানীপাড়া দেখতে আসেন। এই পাড়া বিলুপ্ত হলে প্রভাব পড়বে কুয়াকাটার পর্যটনে।
রাখাইনরা কেন দূরে সরে যাচ্ছে তাদের আদি সংস্কৃতিথেকে, জানতে চাইলে স্থানীয় রাখাইন মংওয়েং (৬৪) বলেন, ‘এই পাড়া থেকে রাখাইনদের বিতাড়িত করারজন্য একটি প্রভাবশালী চক্র তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশেষকরে কুয়াকাটার প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় এখানে জমিরগ্রহণযোগ্যতা বেশি। এসব জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরানিজের দখলে নেওয়ার জন্য কতিপয় লোভী রাখাইনকেফাঁদে ফেলছে।’ সময়ের ব্যবধানে এসব বিনিয়োগকারীমগন সম্পত্তিতে তোলা বহুতল ভবনের বিনিময়ে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে রাখাইনদের এই পাড়া থেকে বিতাড়িত করবেবলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
মংওয়েং বলেন, ‘তবে আমাদের মগন সম্পত্তিতেপাড়াপ্রধান এবং পাড়ার সবার সমন্বিত পূর্বানুমতি ছাড়াকোনো স্থাপনা নির্মাণ করার বিধান না থাকলেও এসববহুতল ভবন তোলা হচ্ছে। আমাদের রাখাইনদের এসবআদি নিদর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগউদ্যোগ নিলেও তা এখন অতিলোভী কতিপয় রাখাইনেরকারণে ভেস্তে যেতে বসেছে।’
এ বিষয়ে কেরানীপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠীর অধিকারআন্দোলন কর্মী লুমা মগনী আক্ষেপ করে বলেন, ‘পাড়ারএই জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেওঅনেকে পেটের দায়ে আপস করছে। তবে আমাদের পাড়ারসম্পত্তিতে অনেক প্রভাবশালী ভুয়া কাগজ বানিয়ে এমনকিনিজস্ব জমিতেও গেড়ে বসেছে। কুয়াকাটা কেরানীপাড়ারআদিবাসী রাখাইনদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
এ অঞ্চলে রাখাইনদের আগে আর কারও পা পড়েনি বলে দাবি করেন কেরানীপাড়ার রাখাইন নেতা উচাচিং মাতুব্বর। বলেন, বর্তমানে হাতেগোনা কিছু রাখাইন থাকলেও তাওএখন নানা জটিলতায় জর্জরিত।
উচাচিং মাতুব্বর বলেন, কুয়াকাটা উপকূলের এই এলাকারসম্পত্তি একসময় রাখাইনদের মালিকানায় থাকলেও এখনমাত্র সামান্য জমির আওতায় কেরানীপাড়াটি দৃশ্যমানরয়েছে। তবে আমাদের বিধানে বহুতল ভবন নির্মাণেরসুযোগ না থাকলেও রুটি-রুজির তাগিদে বাধ্য হচ্ছি।’
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলামবলেন, ‘রাখাইনদের এই আদি বসতিটি পর্যটকদের জন্যএবং পর্যটন শিল্পের জন্য একটি ব্যতিক্রমী সংস্কৃতিরজীবনধারা ছিল। সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওই পাড়াররাখাইনদের জমিগুলোতে বিধি বহির্ভূতভাবে চুক্তি করেবহুতল ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। উপজেলা, জেলাপ্রশাসন কিংবা বিভাগীয় প্রশাসনের কোনোরূপ অনুমতিও নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে তাদের দুটি নোটিশ করা হয়েছে।সেখানে বহুতল ভবন কিংবা হোটেল-মোটেল করারঅনুমতি আছে কি না তা সাবমিট করতে বলা হয়েছে।’
The post কুয়াকাটায় হুমকির মুখে রাখাইনদের অস্তিত্ব appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.