12:15 am, Thursday, 23 January 2025

আজও হয়নি অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা

‘মানুষকে শিক্ষার আলো দিতে পারলে সে নিজেই খুঁজে নেবে তাঁর বাঁচার পথ, সামনে চলার পথ, উন্নয়নের পথ’- এ কথা বিশ্বাস করতেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আর তাই তো তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষার ওপর। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে, শিক্ষার প্রসার ও বিকাশ সাধনে শিক্ষকই যে মূল চালিকাশক্তি এই চরম সত্যটি শহীদ জিয়া ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন আর তা করেছিলেন বলেই দেশের অধিকারবঞ্চিত ও অবহেলিত শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার প্রদান ও মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনিই দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য সর্বপ্রথম চাকরিবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারি কোষাগার থেকে বেতনের ৫০ ভাগ অর্থ প্রদান করেন। শহীদ জিয়াই শিক্ষা ক্ষেত্রের অব্যবস্থা ও বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে সময় শহীদ জিয়ার শিক্ষককল্যাণধর্মী কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় তাঁর উত্তরসূরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষকদের অবসর সুবিধা আইন-২০০২ পাস ও বাস্তবায়ন করে এবং বেতন স্কেলের প্রারম্ভিকের শতভাগ সরকারি কোষাগার থেকে প্রদান করে শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছেন। যা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মান উন্নয়নে গতি সঞ্চার করে। শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি সামনে আসে।

শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তরিত করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে স্পষ্ট করে বলতে হয়, শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে কালে কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের দ্বীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন জ্ঞানের ভান্ডার। অথচ কখনো প্রশ্ন করেননি, প্রতিদানে তিনি কী পেয়েছেন?

শিক্ষার আলো জ্বেলে দেওয়ার মহতী চেতনা ও উপলব্ধি তাঁকে শিক্ষাদানের পবিত্র দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর চাওয়াপাওয়া সীমিত। তিনি জানেন, তাঁর চলার পথ দুর্গম ও বিড়ম্বনাময়। তবু তিনি হৃদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এর জন্য তাঁকে সারা জীবন ত্যাগ করতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। তবু তিনি আদর্শচ্যুত হন না। ন্যায়নীতির প্রশ্নে তিনি কখনোই আপস করেন না। শিক্ষানিকেতন তাঁর কর্মশালা। সেখানে তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও প্রতিভার বিকাশ, প্রসার ও উন্নয়ন সাধনে যথার্থ ভূমিকা রাখেন। একজন আদর্শ শিক্ষক সহজ, সরল, নিরহংকার, উদার, কর্তব্যনিষ্ঠ, নিঃস্বার্থ, নির্ভীক ও প্রগতিশীল মনের অধিকারী পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। নিজের অর্জিত জ্ঞানভান্ডারকে তিনি সমৃদ্ধতর করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করেন নিবেদিত চিত্তে। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, নিরলস পরিশ্রম, সততা ও কঠিন নিয়মশৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস। কর্তব্যকর্ম সম্পাদনে তিনি কখনোই কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করেন না বা নিজের ব্যর্থতার জন্য কোনো অজুহাত সৃষ্টি করেন না। তাঁর সুদৃঢ় চারিত্রিক গ্রানাইট শিলার বেদিমূলে সস্তা জনপ্রিয়তার কোনো স্থান নেই। তাঁর পার্থিব চাহিদা সীমিত, কিন্তু জাতি গঠনে তাঁর স্বপ্ন সীমাহীন। সমাজ ও জাতির অগ্রযাত্রায়, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে, দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এবং বিশ্বের দরবারে নিজ দেশের গৌরবময় অবস্থান গড়ে তুলতে একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। সংগত কারণেই শিক্ষকের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তাদের অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসুরূপে গড়ে তোলাই শিক্ষকদের দায়িত্ব। শিক্ষার্থীর ক্রমোন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষক আন্তরিকতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, অনুশীলন প্রস্তুত, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়ন এবং সহপাঠক্রম পরিচালনা করেন। শিক্ষক এমন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদান করবেন যাতে শিক্ষার্থীর আর গৃহশিক্ষক বা আলাদা করে কোচিংয়ের প্রয়োজন না হয়।

মনে রাখতে হবে, শিক্ষকের নিজের আচরণ যেন তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। শিক্ষককে হতে হবে গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। শিক্ষকের কাজের স্বাধীনতা যেন তাঁর দায়িত্ব পালনের নেতিবাচকতার নামান্তর না হয়। এখন প্রশ্ন এই মহান পেশার প্রতি দেশের শিক্ষকরা কতটা যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটা আন্তরিক? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি আরও প্রশ্ন আসে; যেমন শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ কতটুকু সহায়ক? আবার দেশের এই শ্রেষ্ঠ মানুষ-শিক্ষকরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছেন কি? পাচ্ছেন কি? পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ প্রসঙ্গে নির্দ্বিধায় বলা যায়- শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে প্রচুর অসংগতি। তা ছাড়া শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ডগুলো, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী, অস্পষ্ট, জটিল ও বৈষম্যমূলক বিধিবিধান, নিয়ম নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে প্রতিনিয়ত শিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রভাবশালী, শক্তিধর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিক ও অন্যায় সিদ্ধান্ত দিয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশে বিঘ্ন ঘটায়। এসব ক্ষেত্রে একজন আদর্শ শিক্ষক তাঁর যথাযথ ভূমিকা পালনে কীই-বা করতে পারেন? এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, শিক্ষকের মান উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন প্রতিভাশালী, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা।

শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকের জন্য গবেষণাকর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তবে শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে বলতে হয়, বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। একটি স্বাধীন দেশের জন্য আমাদের শিক্ষকতার অবস্থা লজ্জাজনক।

এ মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর, চলমান ধারাবাহিকতায় সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তর জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ শিক্ষার প্রত্যাশিত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ দূর করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলেই শিক্ষকতা পেশা ক্রমশ মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। পৃথক শিক্ষা সার্ভিস কমিশন গঠন করে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। আবার তেমনই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বিচ্যুত বা বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতির সুযোগ নেই। সৌভাগ্যবান কেউ কোনোমতে এক ধাপ এগোলেও পরবর্তী সব ধাপ বন্ধ। এর ফলে শিক্ষকদের উদ্যমহীনতায় ভুগতে হচ্ছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে এবং কমিটি গঠনে অসংগতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিচালনা কমিটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে ‘ডোনেশনের’ নামে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান ও পরিবেশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটির কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা এখন সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও আংশিক ভাতা সরকারি কোষাগার থেকে প্রদান করছে। তাই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটিপ্রথা অবিলম্বে বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুরূপ বিধিবিধান প্রবর্তন করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা নেই। ফলে পরিবারপরিজন নিয়ে সুন্দর মানসম্পন্ন পরিবেশে বসবাস করার বিষয়টি আজও তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। শিক্ষকদের নিজ কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য কোনো ব্যবস্থা আজও হয়নি এবং চিত্তবিনোদনের বিষয়টি শিক্ষকরা কল্পনাতেই আনতে পারেন না। এটা যেন তাদের জন্য বিলাসী ভাবনা! শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকের কল্যাণে শহীদ জিয়ার অবদানের জন্য তিনি এ দেশের শিক্ষক সমাজের মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন। তাঁর স্মৃতি অম্লান রাখতে প্রবীণ শিক্ষক নেতা, শিক্ষকবন্ধু প্রফেসর এম শরীফুল ইসলামের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতেই ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার প্রথম চেক বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহান নেতা শহীদ জিয়ার জন্মদিবস ১৯ জানুয়ারিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ষপরিক্রমায় প্রতি বছর ১৯ জানুয়ারি জাতীয় শিক্ষক দিবস ফিরে আসে। চলে যায়। দুঃখের বিষয়, এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। আশা করি অদূরভবিষ্যতে জাতি এই দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ এবং সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

The post আজও হয়নি অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.

Tag :

আজও হয়নি অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা

Update Time : 09:07:42 pm, Wednesday, 22 January 2025

‘মানুষকে শিক্ষার আলো দিতে পারলে সে নিজেই খুঁজে নেবে তাঁর বাঁচার পথ, সামনে চলার পথ, উন্নয়নের পথ’- এ কথা বিশ্বাস করতেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আর তাই তো তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষার ওপর। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে, শিক্ষার প্রসার ও বিকাশ সাধনে শিক্ষকই যে মূল চালিকাশক্তি এই চরম সত্যটি শহীদ জিয়া ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন আর তা করেছিলেন বলেই দেশের অধিকারবঞ্চিত ও অবহেলিত শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার প্রদান ও মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনিই দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য সর্বপ্রথম চাকরিবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারি কোষাগার থেকে বেতনের ৫০ ভাগ অর্থ প্রদান করেন। শহীদ জিয়াই শিক্ষা ক্ষেত্রের অব্যবস্থা ও বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে সময় শহীদ জিয়ার শিক্ষককল্যাণধর্মী কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় তাঁর উত্তরসূরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষকদের অবসর সুবিধা আইন-২০০২ পাস ও বাস্তবায়ন করে এবং বেতন স্কেলের প্রারম্ভিকের শতভাগ সরকারি কোষাগার থেকে প্রদান করে শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছেন। যা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মান উন্নয়নে গতি সঞ্চার করে। শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি সামনে আসে।

শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তরিত করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে স্পষ্ট করে বলতে হয়, শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে কালে কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের দ্বীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন জ্ঞানের ভান্ডার। অথচ কখনো প্রশ্ন করেননি, প্রতিদানে তিনি কী পেয়েছেন?

শিক্ষার আলো জ্বেলে দেওয়ার মহতী চেতনা ও উপলব্ধি তাঁকে শিক্ষাদানের পবিত্র দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর চাওয়াপাওয়া সীমিত। তিনি জানেন, তাঁর চলার পথ দুর্গম ও বিড়ম্বনাময়। তবু তিনি হৃদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এর জন্য তাঁকে সারা জীবন ত্যাগ করতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। তবু তিনি আদর্শচ্যুত হন না। ন্যায়নীতির প্রশ্নে তিনি কখনোই আপস করেন না। শিক্ষানিকেতন তাঁর কর্মশালা। সেখানে তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও প্রতিভার বিকাশ, প্রসার ও উন্নয়ন সাধনে যথার্থ ভূমিকা রাখেন। একজন আদর্শ শিক্ষক সহজ, সরল, নিরহংকার, উদার, কর্তব্যনিষ্ঠ, নিঃস্বার্থ, নির্ভীক ও প্রগতিশীল মনের অধিকারী পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। নিজের অর্জিত জ্ঞানভান্ডারকে তিনি সমৃদ্ধতর করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করেন নিবেদিত চিত্তে। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, নিরলস পরিশ্রম, সততা ও কঠিন নিয়মশৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস। কর্তব্যকর্ম সম্পাদনে তিনি কখনোই কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করেন না বা নিজের ব্যর্থতার জন্য কোনো অজুহাত সৃষ্টি করেন না। তাঁর সুদৃঢ় চারিত্রিক গ্রানাইট শিলার বেদিমূলে সস্তা জনপ্রিয়তার কোনো স্থান নেই। তাঁর পার্থিব চাহিদা সীমিত, কিন্তু জাতি গঠনে তাঁর স্বপ্ন সীমাহীন। সমাজ ও জাতির অগ্রযাত্রায়, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে, দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এবং বিশ্বের দরবারে নিজ দেশের গৌরবময় অবস্থান গড়ে তুলতে একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। সংগত কারণেই শিক্ষকের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তাদের অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসুরূপে গড়ে তোলাই শিক্ষকদের দায়িত্ব। শিক্ষার্থীর ক্রমোন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষক আন্তরিকতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, অনুশীলন প্রস্তুত, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়ন এবং সহপাঠক্রম পরিচালনা করেন। শিক্ষক এমন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদান করবেন যাতে শিক্ষার্থীর আর গৃহশিক্ষক বা আলাদা করে কোচিংয়ের প্রয়োজন না হয়।

মনে রাখতে হবে, শিক্ষকের নিজের আচরণ যেন তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। শিক্ষককে হতে হবে গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। শিক্ষকের কাজের স্বাধীনতা যেন তাঁর দায়িত্ব পালনের নেতিবাচকতার নামান্তর না হয়। এখন প্রশ্ন এই মহান পেশার প্রতি দেশের শিক্ষকরা কতটা যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটা আন্তরিক? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি আরও প্রশ্ন আসে; যেমন শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ কতটুকু সহায়ক? আবার দেশের এই শ্রেষ্ঠ মানুষ-শিক্ষকরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছেন কি? পাচ্ছেন কি? পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ প্রসঙ্গে নির্দ্বিধায় বলা যায়- শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে প্রচুর অসংগতি। তা ছাড়া শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ডগুলো, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী, অস্পষ্ট, জটিল ও বৈষম্যমূলক বিধিবিধান, নিয়ম নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে প্রতিনিয়ত শিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রভাবশালী, শক্তিধর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিক ও অন্যায় সিদ্ধান্ত দিয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশে বিঘ্ন ঘটায়। এসব ক্ষেত্রে একজন আদর্শ শিক্ষক তাঁর যথাযথ ভূমিকা পালনে কীই-বা করতে পারেন? এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, শিক্ষকের মান উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন প্রতিভাশালী, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা।

শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকের জন্য গবেষণাকর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তবে শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে বলতে হয়, বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। একটি স্বাধীন দেশের জন্য আমাদের শিক্ষকতার অবস্থা লজ্জাজনক।

এ মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর, চলমান ধারাবাহিকতায় সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তর জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ শিক্ষার প্রত্যাশিত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ দূর করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলেই শিক্ষকতা পেশা ক্রমশ মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। পৃথক শিক্ষা সার্ভিস কমিশন গঠন করে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। আবার তেমনই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বিচ্যুত বা বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতির সুযোগ নেই। সৌভাগ্যবান কেউ কোনোমতে এক ধাপ এগোলেও পরবর্তী সব ধাপ বন্ধ। এর ফলে শিক্ষকদের উদ্যমহীনতায় ভুগতে হচ্ছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে এবং কমিটি গঠনে অসংগতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিচালনা কমিটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে ‘ডোনেশনের’ নামে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান ও পরিবেশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটির কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা এখন সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও আংশিক ভাতা সরকারি কোষাগার থেকে প্রদান করছে। তাই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটিপ্রথা অবিলম্বে বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুরূপ বিধিবিধান প্রবর্তন করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা নেই। ফলে পরিবারপরিজন নিয়ে সুন্দর মানসম্পন্ন পরিবেশে বসবাস করার বিষয়টি আজও তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। শিক্ষকদের নিজ কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য কোনো ব্যবস্থা আজও হয়নি এবং চিত্তবিনোদনের বিষয়টি শিক্ষকরা কল্পনাতেই আনতে পারেন না। এটা যেন তাদের জন্য বিলাসী ভাবনা! শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকের কল্যাণে শহীদ জিয়ার অবদানের জন্য তিনি এ দেশের শিক্ষক সমাজের মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন। তাঁর স্মৃতি অম্লান রাখতে প্রবীণ শিক্ষক নেতা, শিক্ষকবন্ধু প্রফেসর এম শরীফুল ইসলামের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতেই ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার প্রথম চেক বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহান নেতা শহীদ জিয়ার জন্মদিবস ১৯ জানুয়ারিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ষপরিক্রমায় প্রতি বছর ১৯ জানুয়ারি জাতীয় শিক্ষক দিবস ফিরে আসে। চলে যায়। দুঃখের বিষয়, এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। আশা করি অদূরভবিষ্যতে জাতি এই দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ এবং সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

The post আজও হয়নি অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.