
* শুকনো মৌসুমের আগেই অবস্থা বেহাল
* বন্ধ হচ্ছে না নদী দখল
জগদীশ রবিদাস: রাজশাহী শহরের তীর ঘেঁষে প্রবাহিত খরস্রোতা পদ্মা তার জৌলুস হারিয়ে ধারণ করেছে অচেনা রূপ। রাজশাহীবাসীকে যেন ভুলতে বসিয়েছে তার চিরচেনা রূপের তুলনা।
গঙ্গা নদীর প্রধান ধারা এই পদ্মার বুক চিরে এখন নৌকা নয়, বরং চলছে গরু আর মহিষের গাড়ি। চলমান শীত এখনও ফুরাইনি। শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই পদ্মা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। নদী এখন অনেকটাই পানিশূন্য।
সারাদেশে রাজশাহীকে উপস্থাপন করা পদ্মা তার অহংকার ও সৌন্দর্য হারিয়ে এখন যেন পরিনত হয়েছে মরুভূমিতে। কীর্তিনাশা পদ্মায় ধারাবাহিকভাবে পানি কমতে থাকার প্রভাবে এ অঞ্চলের গভীর নলকূপেও দেখা দিয়েছে পানিশূন্যতা। তৈরি হয়েছে কৃষিজমিতে সেচ ও খাওয়ার পানির সঙ্কট।
পদ্মার এমন মরণদশায় ইতিমধ্যেই মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশ পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে। নদীতে প্রবাহ না থাকায় আবাসস্থল হারানোর আশঙ্কায় বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ। গবেষকরা বলছেন, পদ্মার মরতে বসা কারণ ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধের কারণেই এমন সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বলে মতামত তাদের।
এদিকে, উত্তরাঞ্চলের চার জেলায় নদীর জমি দখল করেছেন ৪ হাজার ২৩১ জন। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব দখলদারের তালিকা করেছে। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারেনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী, রাজশাহী ৬০০, নওগাঁয় ২৯২৫ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৬১ ও নাটোরে ৪৪৫ জন দখল করে আছেন নদীর জমি। পদ্মা, মহানন্দা, আত্রাই, বারনই ও নারোদ নদী দখল করে নানা স্থাপনা গড়ে তুলেছেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট নিচে নেমে গেছে। পানি নিচে নেমে যাওয়ায় ভর করেছে আর্সেনিক।
বর্তমানে এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১শ পনের ফিট নিচে অবস্থান করছে। ভূ-উপরিস্থ পানি না থাকায় সীমাহীন গভীর নলকূপের ব্যবহারের প্রভাবে এমনটি হচ্ছে। বরেন্দ্রের অনেক স্থানে ডিপটিউবওয়েলে পানি উঠছেনা। পদ্মার পানির অভাবে দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পসহ পশ্চিমাঞ্চলের বহু সংখ্যক সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়ছে।
স্প্রিংগার থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় উঠে আসা গবেষণার তথ্যে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ।
আর মিঠা পানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এছাড়া পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। ১৯৮১ সালে যেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২ ডিগ্রিতে। মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেয়া হয় বলে জানান গবেষকরা।
গবেষক দলটিতে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহা. গালিব। তিনি বলেন, গণমাধ্যমকে আমরা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু ও নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির সম্পর্কের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করছিলাম। এটা করতে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্মার আয়তন বর্তমানে অর্ধেক কমে গেছে। এর প্রভাবে পদ্মার পুরো জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সরদহ পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ওই এলাকার নয়টি পয়েন্টে মৎস্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্মাপাড়ের ২৭টি জেলেপল্লী থেকে নেয়া হয় তথ্য। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পদ্মার বর্তমান চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছে গবেষক দল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা নদীর চেহারা পাল্টাতে শুরু করে ১৯৭৫ সালের পর। ওই বছর পদ্মার ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। এ বাঁধ দিয়েই ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে পানি প্রত্যাহার শুরু করে প্রতিবেশী দেশটি। এর প্রভাবে পানি কমতে শুরু করে পদ্মায়। গবেষকরা জানান, ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহিত হতো ৯ হাজার ৩২ ঘনমিটার। বাঁধ চালুর পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবাহ নেমেছে ৫ হাজার ১৪৬ ঘনমিটারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে চালু হয় ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৭৭ সালে ভারতের সঙ্গে প্রথম গঙ্গার পানি চুক্তি সই হয়। সঙ্গে যুক্ত ছিল গ্যারান্টি ক্লজ। সামরিক সরকার এরশাদের আমলে এ চুক্তি দুইবার নবায়ন হয়। ১৯৮২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে একই বছর সমঝোতা স্মারক সই হয়। তবে বাদ দেওয়া হয় গ্যারান্টি ক্লজ। যেখানে ছিল বাংলাদেশের হিস্যার ৮০ শতাংশ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা।
সবশেষ ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি যে গঙ্গা চুক্তি করা হয়, তাতেও রাখা হয়নি গ্যারান্টি ক্লজ। চুক্তি অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১০ দিন পরপর ৩৫ হাজার কিউসেক পানি উভয় দেশ পাবে। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর শুকনো মৌসুমে পদ্মার প্রবাহ কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি সেকেন্ডে ২ হাজার ৩৩ ঘনমিটারে। বাঁধ চালুর আগে শুকনো মৌসুমে পদ্মায় প্রবাহ ছিল ৩ হাজার ৬৮৫ ঘনমিটার। কেবল শুকনো মৌসুমেই নয়, বর্ষাকালেও প্রবাহ কমেছে পদ্মায়। ফারাক্কা চালুর আগে বর্ষায় গড় পানির প্রবাহ ছিল সেকেন্ডে ১২ হাজার ১১৫ ঘনমিটার। বর্তমানে এ প্রবাহ নেমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮২৭ ঘনমিটারে। গবেষকরা আরও জানান, ১৯৮০ সালে পদ্মা অববাহিকায় দৈনিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৫ দশমিক ২ মিলিমিটার। ২০১৯ সালে এসে দৈনিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২ মিলিমিটারে।
বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, ভারত আর্ন্তজাতিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে উৎস্য ও উজানে গঙ্গার উপর অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পানি পৌঁছাতে পারছে না। এসব প্রাণঘাতি প্রকল্প অপসারণ করা ছাড়া গঙ্গা-পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার অন্য কোন বিকল্প নেই। ধারাবাহিকভাবে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে উল্লেখ করে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, এ সঙ্কটের শেকড় অনেক গভীরে। পদ্মার এ রুগ্ণ দশার কারণ কী, এটি সবাই বোঝে। সঙ্কট মোকাবেলায় অববাহিকাভিত্তিক বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালকে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।
এদিকে, শহরের পদ্মা নদীর বাঁধের প্রায় ১৭ কিলোমিটার দখলমুক্ত করার দাবি তোলা হয়েছে রাজশাহী থেকে। একইসঙ্গে পদ্মা নদী খনন করে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিও জানানো হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এসব দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে বক্তারা তাদের মতামত দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ার পরেও দখল-দূষণসহ মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে নদীগুলো নানামুখী সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। রাজশাহী অঞ্চলের অনেক নদ-নদীর এখন রুগ্নদশা। অন্যতম নদী পদ্মারও করুণ অবস্থা। নদী নিয়ে একাধিকবার প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা অপরিকল্পিত হওয়ায় দুর্নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে জনগণের অর্থ লুটপাট ও অপচয় হয়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে নাটোরের লালপুর পর্যন্ত পদ্মা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ৬৮টি স্লুইসগেট অচল হয়ে পড়েছে। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে বন্যার মতো দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সময়মতো পদ্মা নদীতে পানি থাকে না। বর্ষাতেও কাক্সিক্ষত পানি আসে না পদ্মায়। আবার শীত শুরুর আগেই পুরো নদী শুকিয়ে খালে পরিণত হয়। এতে পদ্মার সব শাখা নদী ইতিমধ্যে মরেও গেছে। অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে চারঘাটের বড়াল। এসব নদী বাঁচাতে হবে। পানির ন্যায্য অধিকার দিতে হবে এবং পদ্মায় পানিপ্রবাহ ফেরাতে হবে। পদ্মা নদীর ১৭ কিলোমিটার বাঁধ দখল করে রাখা হয়েছে। এই বাঁধ অতি দ্রুত দখলমুক্ত করতে হবে।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, গঙ্গা চুক্তি শেষ হবে ২০২৬ সালে। জানা নেই এই চুক্তির কী হবে। এখানে পানি না থাকলে সব নদী মরে যাবে। পানি ছাড়া এই অঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাবে। পানিই যদি না থাকে, তাহলে কিসের উন্নয়ন। পদ্মা নদী শুকিয়ে গেছে। এই পদ্মা নদীকে বাঁচাতে হলে খনন করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা নদী দখলের তালিকা করেছি। সেই তালিকা জেলা প্রশাসককে দেয়া হয়েছে। এখন জেলা প্রশাসক উচ্ছেদ অভিযান চালাবেন। জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার গণমাধ্যমকে জানান, শিগগিরই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
The post খরস্রোতা পদ্মা এখন শুধুই ধু-ধু মাঠ appeared first on সোনালী সংবাদ.