
বিশেষ প্রতিনিধি:

দেশে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সরকারের দেওয়া বিশেষ বরাদ্দে ভাগ বসিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পরে বরিশালে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) একাধিক ডিলারের কাছ থেকে জোরপূর্বক পণ্য নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সুবিধাবাদী একটি গোষ্ঠী স্থানীয় বিএনপির গুটিকয়েক নেতাকর্মীকে সামনে রেখে নিম্নবিত্তদের খাদ্যপণ্য লুটপাট চালিয়ে তুমুল বির্তক তৈরি করার পাশাপাশি দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করছে, যা নিয়ে বরিশালের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা-সমালোচনা শোনা যায়।
সবশেষ গতকাল রোববার কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভিজিএফের (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) ৪০০ স্লিপ জোরপূর্বক বিএনপি নেতাকর্মীরা নিয়ে গেছে। এর আগে বরিশাল নগরীতে একাধিক টিসিবি ডিলারের কাছে থেকে পণ্য জোরপূর্বক নিয়ে যায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। অসহায় মানুষকে সরকারের দেওয়া বিশেষ বরাদ্দে বিএনপি নেতাকর্মীদের রাক্ষুসে থাবা ফেলবার বিষয়টিকে নৈতিবাচক হিসেবে দেখছে স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছে, নিম্নবিত্তদের সরকারি সহায়তায় বিএনপি নেতাকর্মীরা ৫ আগস্টের পরে একাধিকবার থাবা বসিয়েছে। এবং এই প্রতিটি ঘটনায়ই বিএনপির বদনাম হয়েছে, হচ্ছে, যা দলের জন্য অশানিসংকেত বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য একথা বরিশাল বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরাও স্বীকার করেছেন। এবং চেয়েছেন জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত দুটো প্রক্রিয়াতেই ব্যবস্থাগ্রহণ।
সূত্রে জানা গেছে, সবশেষ গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে বিএনপি নেতা মো. দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে আব্দুল হক শিকার, আবু তাহের মাহামুদ খোকন এবং হানিফ হাওলাদারসহ অন্তত ১৫/২৫ জনের একটি বহর বরিশাল সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদে প্রবেশ করে হম্বিতম্বি মারতে শুরু করে। একপর্যায়ে পরিষদ সচিব আব্দুল করিমকে চাপপ্রয়োগ করাসহ অসহায় ও দরিদ্রদের জন্য সরকারের দেওয়া ভিজিএফ সহায়তার স্লিপ নিয়ে যেতে চায়। এতে বাধা দিলে বিএনপি নেতাকর্মীরা পরিষদ সচিবসহ গ্রামপুলিশকেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। এবং শেষ পর্যন্ত জোরপূর্বক ৪০০ স্লিপ নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
সচিব আব্দুল করিম জানান, ভিজিএফের পণ্য বিরতণ নিয়ে ইতিপূর্বে ইউনিয়ন বিএনপি নেতাদের সাথে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। সেখানে দায়িত্বশীল নেতারা এতে হস্তক্ষেপ করবেন না জানিয়ে বৈধপন্থায় প্রকৃত অসহায়-দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হন ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেনসহ ধান্ধাবাজ একটি গ্রুপ। বিষয়টি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) তাৎক্ষণিক অবহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি অসহায় মানুষের খাবারে থাবা বসানোর বিষয়টি ইউনিয়ন বিএনপির নেতাদেরও জানানো হলেও তারাও চটেছেন বলে শোনা গেছে।
ফোন করে এই বিষয়ে বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছেন এবং গাড়িতে আছেন জানিয়ে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিছুক্ষণ পরে আব্দুল হক সিকদার নামের জনৈক ব্যক্তি ফোন করে নিজেকে বিএনপি নেতা পরিচয় দেন এবং ঘটনাটিতে চেপে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাতের অনুরোধ রাখেন। কিন্তু প্রতিবেদক সাক্ষাৎ করার প্রয়োজনীয়তা নেই জানিয়ে দিলে বিএনপি নেতা মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এর মিনিট পাঁচেকের মাথায় একই ঘটনায় কাজী জাহাঙ্গীর নামের জনৈক ব্যক্তি ফোন করে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন এবং কাশিপুরের সংবাদটি চেপে যাওয়ার অনুরোধ রাখেন। কিন্তু এমন দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে দিলে তিনিও ফোনটি কেটে দেন।
এই বিষয়টি নিয়ে সংক্ষুব্ধ কাশিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকও। তারা জানিয়েছেন, ভিজিএফের স্লিপ নেওয়ার সাথে দলগতভাবে বিএনপির কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যারা এমন বিতর্কিত কাজ করেছে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করার সুপারিশ চাওয়া হয়েছে উপজেলা বিএনপি নেতৃত্বর কাছে।
গরিবের খাবারে দলীয় কর্মীদের থাবা বসানোর বিষয়টি সম্পর্কে ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছেন বরিশাল সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জিয়াউল ইসলাম সাবু। তিনি জানান, ঘটনাটি বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন। এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে। এই নেতার দাবি জিয়াউর রহমানের আদর্শ ধারন করেন, এমন নেতাকর্মীরা এই ধরনের কার্যকলাপে যুক্ত হতে পারেন না।
এর আগে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দরিদ্র মানুষের খাবারের ওপর থাবা বাসায় ২৭ নং ওয়ার্ড বিএনপির নেতা জসিম এবং জহিরুল ইসলাম নান্টু তালুকদার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডিলারের কাছ থেকে ৯০ জনের পণ্য জোরপূর্বক নিয়ে গেছেন। এবং পরবর্তীতে তা বিএনপি নেতাদ্বয় নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা ৩০টি ওয়ার্ডেই এমনিভাবে অসহায়-দরিদ্র মানুষের খাবারের ওপর থাবা বসিয়েছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বরিশালের প্রশাসনিক মহলেও কমবেশি আলোচনা-সমালোনা শোনা যায়।
কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিএনপি নেতারা ভিজিএফের ৪০০ স্লিপ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইকবাল হাসান। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ইউনিয়ন পরিষদ সচিব বিষয়টি তাকে অবহিত করেছে। এরপরে স্লিপগুলো বাতিল করে নতুন স্লিপ তৈরি করে খাদ্যসামগ্রী বিতরণে উদ্যোগ নেওয়া হবে। ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের এমন নেতিবাচক কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ জেলা-মহানগর এবং উপজেলার শীর্ষ নেতাকর্মীরা।
এই ধরনের কর্মকান্ড করলে কোনো ছাড় নেই বলে মন্তব্য করেছেন বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক। তিনি জানান, বিতর্কিত কর্মকান্ডে যারা সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ রাখা হচ্ছে, যার প্রেক্ষিতে অনেকে বহিস্কারও হচ্ছেন। এখন নতুন করে যারা অপরাধে জড়িয়ে আলোচনায় আছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে, সেক্ষেত্রে তিনি যে নেতার অনুসারী বা যত বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হন না কেনো।
অবশ্য বরিশাল মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতারা ইতিপূর্বে এই ধরনের হুঁশিয়ারি একাধিকবার দিয়েছিলেন। কিন্তু যারা মাঠপর্যায়ে অপকর্ম করছেন, তাদেরকে শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি-কাছাকাছিও দেখা যায়। উদাহরণস্বরুপ কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদে যারা সন্ত্রাস করেছে, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের রহমত উল্লাহ’র বিরুদ্ধে। জানা গেছে, রহমত উল্লাহ বরিশাল সদর উপজেলা বিএনপির ১ নং সদস্য। এই বিষয়ে জানতে বিএনপি নেতা রহমত উল্লাহকে ফোন করা হলে তিনি কলটি রিসিভ করেননি।
অভিজ্ঞমহল বলছে, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডপর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা যে ত্রাস শুরু করেছে, এতে শুধু তাদের দুর্নাম হচ্ছে না। বরং বিএনপিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিকবার নিষেধ করাসহ নানা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কিন্তু তারপরেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমনিভাবে চলতে থাকলে বিএনপিকে চরম খেসারত দিতে হবে। সুতরাং কালবিলম্ব না করে জনস্বার্থবিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাগ্রহণের পাশাপাশি আইনে সোপর্দ করা উচিৎ, মন্তব্য পাওয়া গেছে।’
The post বরিশালের কাশিপুরে নিম্নবিত্তদের সরকারি সহায়তায় বিএনপি নেতাদের থাবা! appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.