6:00 am, Saturday, 22 March 2025
Aniversary Banner Desktop

২০ মার্চ খুলনার দেশের ডাকে ছাপা হয় লাল সবুজের পতাকা

তখন জেঃ মো. আইয়ুব খান দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি পাকিস্তানের লৌহ মানব হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিত। ১৯৫৮ সালে জেঃ ইস্কান্দার মীর্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দেশে সামরিক শাসন। রাজনৈতিক তৎপরতার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতা দিবস পালন হত ১৪ আগস্ট তারিখে। ২১ ফ্রেব্রুয়ারি পালন হত সংক্ষিপ্ত পরিসরে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বলতে ছিল নয়া সাংস্কৃতিক সংসদ, সন্দীপন ও নাট্য নিকেতন কেন্দ্রীক।

খুলনা শহরের পরিধি ছিল স্বল্প পরিসরে। শিল্প কল কারখানার মধ্যে নিউজপ্রিন্ট মিলস, হার্ডবোর্ড মিলস, কেবল শিল্প, কোরেশী ষ্টিল মিলস, ক্রিসেন্ট জুট মিলস, প্লাটিনাম জুবলী জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, সোনালী জুট মিলস, শিপইয়ার্ড, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী, টেক্সটাইল মিল ও চালনা বন্দর (আজকের মোংলা বন্দর) চালু হয়েছে। স্কুল-কলেজ বলতে বি এল, খুলনা সরকারী মহিলা মহাবিদ্যালয়, জিলা স্কুল, সেন্ট জোসেফস, মডেল, বি কে, মুহসিন, মহেশ্বরপাশা, করোনেশন, পল্লীমঙ্গল, সেনহাটী, নৈহাটী আর সাতক্ষীরা পি এন হাই স্কুল। রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতে ইসলামী আর নেজামে ইসলামী।

সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ বিত্তবান মানুষ, কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িতরা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে। ফলে কংগ্রেসের অস্তিত্ব বলতে আর কিছু ছিল না। দেশ বিভাগের পর খুলনা থেকে তাহজীব, তওহীদ, তকবীর, প্রবাহ, পাক-পয়গাম ও সবুজপত্র নামের পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হত। পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির ১৭ বছর পর ১৯৬৪ সালে খুলনা শহরের ক্লে রোড (হ্যানিম্যান ফার্মেসীর পাশে) থেকে দেশের ডাক নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র লুৎফর রহমান জাহানগীর এ সাপ্তাহিকের সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি এম এ ক্লাসে প্রথম শ্রেণিতে পাস করার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৩৭ সালের ৮ আগস্ট তার জন্ম। সরদার নকীব উদ্দীন আহমেদ তার পিতা, ফাতেমা খাতুন তার মা। ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে জীবনীতে উল্লেখ করেন, খুলনা প্রেসক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি গর্বিত ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালে নয়া সাংস্কৃতিক সংসদের ব্যানারে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে মাসিক গণশক্তি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা পেশার সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৩ সালে মাসিক তকবীর এবং ১৯৫২-৫৪ সালে সাপ্তাহিক আল হাদী পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম-আহবায়ক, ১৯৫৪ সালে খুলনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার সময়েই গণতন্ত্রী দলে যোগদান করেন।

১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী দলের খুলনা জেলা শাখার যুগ্ম-সম্পাদক, ১৯৫৪-৫৫ সালে যুবলীগের খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের গৌরব তার। শহরে পরিচিতি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধা নিয়ে ১৯৬৪ সালের ১৭ অক্টোবর ‘দেশের ডাক’ নামক সাপ্তাহিকটি তিনি প্রকাশ করেন। পাকিস্তান জামানায় খুলনার সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য দিন। সম্মিলিত বিরোধী দল মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহ ১৭ অক্টোবর খুলনায় আসেন। সেদিনেই তিনি খুলনায় এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করেন। তিনি স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল জেঃ মো. আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ১৭ অক্টোবরের পর দিন জনসভার বিবরণ দিয়ে সাপ্তাহিক দেশের ডাক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যদিও দেশের ডাক ছিল সাপ্তাহিক। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মিস ফাতেমা জিন্নাহর জনসভার খবর প্রচার করায় সহজেই পত্রিকাটি তখনকার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথম দিকে আইডিয়াল প্রেসে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। তারপর ডাকবাংলা ভবনের বিপরীতে নটরাজ প্রেস থেকে ছাপা হয়। আট পৃষ্ঠার এই কাগজটির মূল্য ছিল ১৫ পয়সা। তখনকার দিনে নিয়মিত বেতনভুক্ত সাংবাদিক ছিল না। প্রয়াত বিদ্যুৎ সরকার, মরহুম সৈয়দ ইসা, মরহুম শেখ আবদুল কাইয়ুম পত্রিকাটিতে নিয়মিত লিখতেন। এ পত্রিকার নিয়মিত কলামগুলোর মধ্যে শিরোনাম ছিল ‘এই শহর খুলনা’, ‘কর্তৃপক্ষ সমীপে’, ‘দেশের ডাক সাময়িকী’, ‘সাহিত্য পাতা’, ‘অন্য পত্রিকা থেকে’, এবং ‘বাণিজ্য বার্তা’। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হত। তার মধ্যে স্বাধীনতা দিবস, পাকিস্তান দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি ও দুই ঈদ।

১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করলে দেশের ডাক তার প্রতি সমর্থন জানায়। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে দেশের ডাকের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ৬৮-৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলায় প্রহসনের বিচারের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে ‘দেশের ডাক’ উৎসাহিত করে। নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় লিখে পত্রিকাটি ছয় দফাকে মানুষের কাছে প্রিয় করে তোলে। ১৯৬৮ সালের ১৭ ও ২০ অক্টোবর খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্সের ওপর দুটো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ওই বছরের শেষের দিকে রূপসী নামে রম্য সংখ্যা প্রকাশ করে। প্রচার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ হাজারে। পাকিস্তানের শেষ দিকে ‘দেশের ডাক’ জনপ্রিয় পত্রিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৬৯ সালে ২১ ফ্রেব্রুয়ারি হাজী মহসিন রোড ও সার্কিট হাউজের সামনে খান এ সবুরের বাস ভবনের সামনে পুলিশ ও ইপিআর-এর গুলিতে লন্ড্রী শ্রমিক হাদিস, স্কুল ছাত্র প্রদীপ ও টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক আলতাফ শহিদ হলে দেশের ডাক স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করে। জিন্নাহ পার্কের পরিবর্তে হাদিস পার্ক নামকরণে সাপ্তাহিকটির ভূমিকা ছিল ইতিবাচক।

১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট জেঃ মো. আইয়ুব খান পদত্যাগ করলে সেনাবাহিনী প্রধান জেঃ ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক শাসন ও নানা বিধি আরোপ করে। সংবাদপত্রের জন্য ৬, ১৭ ও ১৯ ধারা জারী করে স্বাধীন মতামতকে কেড়ে নেওয়া হয়। এই ধারায় বলা হয়, পত্র-পত্রিকা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি, ৬ দফা, আগরতলা মামলা ইত্যাদি নিয়ে উস্কানিমূলক প্রতিবেদন ছাপলে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা হবে। দুর্বার গণআন্দোলনের স্রোতে ভেসে যায় জেঃ ইয়াহিয়া খানের সামরিক বিধি। এ ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক দেশের ডাক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। অংশগ্রহণ করে সংগ্রামী জনতার পক্ষে। সম্পাদক ‘শ্রীমান চরসানন্দ’ ছদ্মনামে কলাম লিখতেন। এই কলামের শিরোনাম ছিল ‘ভেলকি ঠাকুরের বাক্স’। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সাপ্তাহিক দেশের ডাক আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেয়। ৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব সাফল্য ছিল। মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী খান এ সবুরকে ব্যঙ্গ করে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। খান এ সবুর পাইকগাছা নিয়ে গঠিত খুলনা-৪ সংসদীয় এলাকা থেকে পরাজিত হন। তখনকার দিনের পত্র-পত্রিকাগুলো আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এম এ গফুরের কাছে খান এ সবুরের পরাজয়কে চুয়ান্ন সালের নির্বাচনের সাথে তুলনা করেন। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয় ‘খান এ সবুরের ভরাডুবি’। যদিও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে খুলনা জেলার তিনটি আসন থেকে খান এ সবুর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সাপ্তাহিক দেশের ডাকের অবস্থান ছিল ইতিবাচক। খুলনায় ৩ মার্চের গুলিবর্ষণের ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। সম্পাদক তার জীবনীতে উল্লেখ করেন ২০ মার্চ তারিখে ‘দেশের ডাক’ এর পূর্ণপৃষ্ঠায় বাংলাদেশের পতাকার রঙিন ছবি ছাপা হয়। এটাই দেশের ডাকের শেষ সংখ্যা।

সংসদ সদস্য স ম বাবর আলী তার স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান নামক বইয়ে উল্লেখ করেন, দেশের ডাকের ওই সংখ্যা দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে। সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাক বাহিনীর কাছে এ খবর পৌঁছে যায়। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী দেশের ডাকের নটরাজ প্রেসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর দেশের ডাক আর প্রকাশিত হয়নি।

খুলনা গেজেট/এএজে

The post ২০ মার্চ খুলনার দেশের ডাকে ছাপা হয় লাল সবুজের পতাকা appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.

Tag :
জনপ্রিয়

‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে আপত্তি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি

ndax login

https://ndaxlogi.com

latitude login

https://latitude-login.com

phantom wallet

https://phantomwallet-us.com

phantom

atomic wallet

atomic

https://atomikwallet.org

jupiter swap

jupiter

https://jupiter-swap.com

https://images.google.com/url?q=https%3A%2F%2Fsecuxwallet.us%2F

secux wallet

secux wallet

secux wallet connect

secux

https://secuxwallet.com

jaxx wallet

https://jaxxwallet.live

jaxxliberty.us

gem visa login

jaxx wallet

jaxx wallet download

https://jaxxwallet.us

toobit-exchange.com Toobit Exchange | The Toobit™ (Official Site)

secuxwallet.com SecuX Wallet - Secure Crypto Hardware Wallet

jaxxliberty.us Jaxx Liberty Wallet | Official Site

Atomic Wallet Download

Atomic

Aerodrome Finance

২০ মার্চ খুলনার দেশের ডাকে ছাপা হয় লাল সবুজের পতাকা

Update Time : 11:08:33 pm, Thursday, 20 March 2025

তখন জেঃ মো. আইয়ুব খান দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি পাকিস্তানের লৌহ মানব হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিত। ১৯৫৮ সালে জেঃ ইস্কান্দার মীর্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দেশে সামরিক শাসন। রাজনৈতিক তৎপরতার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতা দিবস পালন হত ১৪ আগস্ট তারিখে। ২১ ফ্রেব্রুয়ারি পালন হত সংক্ষিপ্ত পরিসরে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বলতে ছিল নয়া সাংস্কৃতিক সংসদ, সন্দীপন ও নাট্য নিকেতন কেন্দ্রীক।

খুলনা শহরের পরিধি ছিল স্বল্প পরিসরে। শিল্প কল কারখানার মধ্যে নিউজপ্রিন্ট মিলস, হার্ডবোর্ড মিলস, কেবল শিল্প, কোরেশী ষ্টিল মিলস, ক্রিসেন্ট জুট মিলস, প্লাটিনাম জুবলী জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, সোনালী জুট মিলস, শিপইয়ার্ড, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী, টেক্সটাইল মিল ও চালনা বন্দর (আজকের মোংলা বন্দর) চালু হয়েছে। স্কুল-কলেজ বলতে বি এল, খুলনা সরকারী মহিলা মহাবিদ্যালয়, জিলা স্কুল, সেন্ট জোসেফস, মডেল, বি কে, মুহসিন, মহেশ্বরপাশা, করোনেশন, পল্লীমঙ্গল, সেনহাটী, নৈহাটী আর সাতক্ষীরা পি এন হাই স্কুল। রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতে ইসলামী আর নেজামে ইসলামী।

সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ বিত্তবান মানুষ, কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িতরা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে। ফলে কংগ্রেসের অস্তিত্ব বলতে আর কিছু ছিল না। দেশ বিভাগের পর খুলনা থেকে তাহজীব, তওহীদ, তকবীর, প্রবাহ, পাক-পয়গাম ও সবুজপত্র নামের পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হত। পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির ১৭ বছর পর ১৯৬৪ সালে খুলনা শহরের ক্লে রোড (হ্যানিম্যান ফার্মেসীর পাশে) থেকে দেশের ডাক নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র লুৎফর রহমান জাহানগীর এ সাপ্তাহিকের সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি এম এ ক্লাসে প্রথম শ্রেণিতে পাস করার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৩৭ সালের ৮ আগস্ট তার জন্ম। সরদার নকীব উদ্দীন আহমেদ তার পিতা, ফাতেমা খাতুন তার মা। ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে জীবনীতে উল্লেখ করেন, খুলনা প্রেসক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি গর্বিত ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালে নয়া সাংস্কৃতিক সংসদের ব্যানারে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে মাসিক গণশক্তি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা পেশার সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৩ সালে মাসিক তকবীর এবং ১৯৫২-৫৪ সালে সাপ্তাহিক আল হাদী পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম-আহবায়ক, ১৯৫৪ সালে খুলনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার সময়েই গণতন্ত্রী দলে যোগদান করেন।

১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী দলের খুলনা জেলা শাখার যুগ্ম-সম্পাদক, ১৯৫৪-৫৫ সালে যুবলীগের খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের গৌরব তার। শহরে পরিচিতি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধা নিয়ে ১৯৬৪ সালের ১৭ অক্টোবর ‘দেশের ডাক’ নামক সাপ্তাহিকটি তিনি প্রকাশ করেন। পাকিস্তান জামানায় খুলনার সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য দিন। সম্মিলিত বিরোধী দল মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহ ১৭ অক্টোবর খুলনায় আসেন। সেদিনেই তিনি খুলনায় এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করেন। তিনি স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল জেঃ মো. আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ১৭ অক্টোবরের পর দিন জনসভার বিবরণ দিয়ে সাপ্তাহিক দেশের ডাক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যদিও দেশের ডাক ছিল সাপ্তাহিক। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মিস ফাতেমা জিন্নাহর জনসভার খবর প্রচার করায় সহজেই পত্রিকাটি তখনকার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথম দিকে আইডিয়াল প্রেসে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। তারপর ডাকবাংলা ভবনের বিপরীতে নটরাজ প্রেস থেকে ছাপা হয়। আট পৃষ্ঠার এই কাগজটির মূল্য ছিল ১৫ পয়সা। তখনকার দিনে নিয়মিত বেতনভুক্ত সাংবাদিক ছিল না। প্রয়াত বিদ্যুৎ সরকার, মরহুম সৈয়দ ইসা, মরহুম শেখ আবদুল কাইয়ুম পত্রিকাটিতে নিয়মিত লিখতেন। এ পত্রিকার নিয়মিত কলামগুলোর মধ্যে শিরোনাম ছিল ‘এই শহর খুলনা’, ‘কর্তৃপক্ষ সমীপে’, ‘দেশের ডাক সাময়িকী’, ‘সাহিত্য পাতা’, ‘অন্য পত্রিকা থেকে’, এবং ‘বাণিজ্য বার্তা’। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হত। তার মধ্যে স্বাধীনতা দিবস, পাকিস্তান দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি ও দুই ঈদ।

১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করলে দেশের ডাক তার প্রতি সমর্থন জানায়। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে দেশের ডাকের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ৬৮-৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলায় প্রহসনের বিচারের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে ‘দেশের ডাক’ উৎসাহিত করে। নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় লিখে পত্রিকাটি ছয় দফাকে মানুষের কাছে প্রিয় করে তোলে। ১৯৬৮ সালের ১৭ ও ২০ অক্টোবর খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্সের ওপর দুটো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ওই বছরের শেষের দিকে রূপসী নামে রম্য সংখ্যা প্রকাশ করে। প্রচার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ হাজারে। পাকিস্তানের শেষ দিকে ‘দেশের ডাক’ জনপ্রিয় পত্রিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৬৯ সালে ২১ ফ্রেব্রুয়ারি হাজী মহসিন রোড ও সার্কিট হাউজের সামনে খান এ সবুরের বাস ভবনের সামনে পুলিশ ও ইপিআর-এর গুলিতে লন্ড্রী শ্রমিক হাদিস, স্কুল ছাত্র প্রদীপ ও টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক আলতাফ শহিদ হলে দেশের ডাক স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করে। জিন্নাহ পার্কের পরিবর্তে হাদিস পার্ক নামকরণে সাপ্তাহিকটির ভূমিকা ছিল ইতিবাচক।

১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট জেঃ মো. আইয়ুব খান পদত্যাগ করলে সেনাবাহিনী প্রধান জেঃ ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক শাসন ও নানা বিধি আরোপ করে। সংবাদপত্রের জন্য ৬, ১৭ ও ১৯ ধারা জারী করে স্বাধীন মতামতকে কেড়ে নেওয়া হয়। এই ধারায় বলা হয়, পত্র-পত্রিকা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি, ৬ দফা, আগরতলা মামলা ইত্যাদি নিয়ে উস্কানিমূলক প্রতিবেদন ছাপলে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা হবে। দুর্বার গণআন্দোলনের স্রোতে ভেসে যায় জেঃ ইয়াহিয়া খানের সামরিক বিধি। এ ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক দেশের ডাক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। অংশগ্রহণ করে সংগ্রামী জনতার পক্ষে। সম্পাদক ‘শ্রীমান চরসানন্দ’ ছদ্মনামে কলাম লিখতেন। এই কলামের শিরোনাম ছিল ‘ভেলকি ঠাকুরের বাক্স’। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সাপ্তাহিক দেশের ডাক আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেয়। ৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব সাফল্য ছিল। মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী খান এ সবুরকে ব্যঙ্গ করে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। খান এ সবুর পাইকগাছা নিয়ে গঠিত খুলনা-৪ সংসদীয় এলাকা থেকে পরাজিত হন। তখনকার দিনের পত্র-পত্রিকাগুলো আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এম এ গফুরের কাছে খান এ সবুরের পরাজয়কে চুয়ান্ন সালের নির্বাচনের সাথে তুলনা করেন। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয় ‘খান এ সবুরের ভরাডুবি’। যদিও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে খুলনা জেলার তিনটি আসন থেকে খান এ সবুর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সাপ্তাহিক দেশের ডাকের অবস্থান ছিল ইতিবাচক। খুলনায় ৩ মার্চের গুলিবর্ষণের ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। সম্পাদক তার জীবনীতে উল্লেখ করেন ২০ মার্চ তারিখে ‘দেশের ডাক’ এর পূর্ণপৃষ্ঠায় বাংলাদেশের পতাকার রঙিন ছবি ছাপা হয়। এটাই দেশের ডাকের শেষ সংখ্যা।

সংসদ সদস্য স ম বাবর আলী তার স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান নামক বইয়ে উল্লেখ করেন, দেশের ডাকের ওই সংখ্যা দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে। সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাক বাহিনীর কাছে এ খবর পৌঁছে যায়। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী দেশের ডাকের নটরাজ প্রেসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর দেশের ডাক আর প্রকাশিত হয়নি।

খুলনা গেজেট/এএজে

The post ২০ মার্চ খুলনার দেশের ডাকে ছাপা হয় লাল সবুজের পতাকা appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.