
ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল গত পনের বছরে বিরোধ মিটিয়ে হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের কথিত নাটের গুরু হিসাবে পরিচিত এই বাবুল আ’লীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে গড়েছেন বিপুল সম্পদ, গাড়ী-বাড়ী ও বিত্তবৈভব। তাঁর বিরুদ্ধে গত ৫ আগষ্টের পর সাগর হত্যা মামলাসহ থানা ও আদালতে একাধিক মামলা দায়ের হলেও এখনো তিনি রয়েছে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এনিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারসহ সচেতন মহলে ক্ষোভ অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল আইন পেশার আড়ালে তিনি ছিলেন পুরো জেলার অলিখিত বিচারক। পারিবারিক থেকে রাজনৈতিক যেকোনো বিষয়ে কোন বিরোধ হলেই বিচার আসত তার ব্যাক্তিগত চেম্বারে। আর এ সুযোগে তাঁর অনুগত পক্ষকে সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তিনি কখনো এমপি কিংবা মন্ত্রী ছিলেন না, শুধু জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ ব্যবহার করেই গড়ে তোলেন প্রভাব প্রতিপত্তি। তাঁর মুখের কথাই ছিল আইন। আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড কাজে লাগিয়ে নিযার্তন, দখলবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, মনোনয়ন বানিজ্য, পদবাণিজ্য এবং বিএনপি জামায়াত দমনে শুরু করেন একের পর এক মিশন। শুধু তাই নয়, স্থানীয় প্রশাসনকে জিম্মি করে আইন পেশায় সম্পৃক্ত থেকেও দেখিয়েছেন ক্ষমতার দাপট।
জেলার একাধিক আইনজীবী জানান, জেলা সমিতির ভবনের পাশেই জেলা পরিষদেও সরকারি জায়গা দখল কওে বিলাসবহুল চেম্বার বানিয়েছিলেন বাবুল। সেখানে সকাল থেকে রাত অবধি জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বসে থাকতো, চলত দেন-দরবার। এ চেম্বারেই চলতো পুরো জেলার অলিখিত নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা। তবে ৫ আগস্টের পর সাধারণ মানুষের ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার এ চেম্বার। এর মধ্যে সরকার পতনের পর এই চেম্বাওে আসা যাওয়া করা গুটি কয়েক চুনোপুঁটি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও এখনো বড় রাঘববোয়ালরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অভিযোগ উঠৈছে, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের আড়াই একর জমি আওয়ামী লীগের শাসনামলে দখলে নিয়ে কয়েক কোটি টাকার বানিজ্য করেছেন বাবুল। এছাড়াও ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশেই চুরখাই এলাকায় প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের তিন একর জমি দখল করেছেন এই আ’লীগ নেতা।
নগরীর জুবিলীঘাট রোডে রাফি ডোর নামক ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক জয়নাল আবেদীন বলেন, আমাদের ভাইদের পৈত্রিক ১৫ শতাংশ ৬৪ পয়েন্ট যায়গার উপর রয়েছে দোকান। ২০১৩ সালে এ জায়গার উপর বহুতল ভবন নির্মানের জন্য জয়নালের আবেদীন গংয়ের সাথে চুক্তি করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল। চুক্তির চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৭ সালের মাঝে ১৮ তলা বিল্ডিং এর কাজ শেষ করার চুক্তি ছিল। এ সুযোগে আমাদের কাছ থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের জমি পাওয়ার অব এটর্নি করে লিখে নেয় মোয়াজ্জেম বাবুল। পরে ২০২২ সাল পর্যন্তও কাজ শুরু না করায় বাবুলের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি আমরা। এতে আমরা টাকা ক্ষতির পাশাপাশি জীবন শঙ্কায় পড়েছিলাম।
ভুক্তভোগীরা জানান, নগরীতে কোনো বহুতল ভবন তৈরী করার সময় নিজের লোকদের দিয়ে ভবন মালিকদের ঝামেলায় ফেলত বাবুল। পরে তার কাছেই বিচারের দ্বারস্থ হলেই ফ্ল্যাট বা নগদ মোটা অংকের টাকা নিয়ে সমাধান দিতেন তিনি। এভাবে তিনি ১৮ তলা ভবন মৈত্রী টাওয়ারে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটসহ একাধিক ভবনে ফ্ল্যাটের মালিক বনে যান রাতারাতি।
সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ নগরীর অভিজাতপাড়া বলে খ্যাত গুলকিবাড়িতে ৫৭ শতাংশ জমিতে বিলাসবহুল ১৯ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং করার চুক্তি হয় ডেভোলোপার কোম্পানি নূরজাহান গার্ডেনের সাথে। কিন্তু জমিতে ওয়ারিশ সূত্রে পরিবারের মাঝে ঝামেলা থাকায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল মধ্যস্থতা করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও নগরীর ব্রীজ মোড়ে রয়েল মিডিয়া কলেজের নিজস্ব জমিতে মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকায় প্রভাব খাটিয়ে কলেজটিতে শেয়ার নেন তিনি। সেই সঙ্গে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ১৮ বাড়ী বিল্ডিং এলাকায় তিনি নিজ মালিকানায় গড়ে তোলেন বহুতল ভবন। প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের এ ভবনের জমির মালিকানা নিয়েও প্রশাসনের কাছে বিচার প্রার্থী হয়েও সুরাহা পাননি একটি পক্ষ। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপটে তারা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু নগরীতে নয় নিজের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার সাধুয়া গ্রামেও প্রভাব খাটিয়ে কয়েক একর জায়গা দখল করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতা। এলাকাবাসী জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের ভাতিজা ত্বকীকে নিয়ে স্থানীয় ইয়াসিন খানের ফিশারির প্রজেক্ট দখল করে নেন বাবুল। এখান থেকে বছরে কয়েক কোটি টাকা মুনাফা নিয়েছেন তিনি। এছাড়াও তার বাড়ির পাশের আবু সাঈদিয়া দাখিল মাদ্রাসার পুকুরটি গত ১৫ বছর যাবৎ দখলে রেখেছেন বাবুল। এ থেকে প্রাপ্ত আয় মসজিদ মাদ্রাসার ফান্ডে না দিয়ে নিজেই আত্মসাত করেছেন বাবুল।
আওয়ামীলীগের একটি অংশের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকাকালে বাবুল অর্থের লোভে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি নৌকার পক্ষে কাজ না করে ডামি প্রার্থীদের পক্ষ নিয়েছিলেন। ময়মনসিংহ জেলার ১১ টি সংসদীয় আসনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে ৫টি আসনে ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছেন। তাদের অভিযোগ, এর বিনিময়ে তিনি সেসব প্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা ও বাড়ি, গাড়ী। এ নিয়ে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তিনি কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন।
জানা যায়, ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর পালিয়ে যান মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল। বিক্ষুব্ধ জনতা পরে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়। এতে তাঁর সামন্য ক্ষতি হলেও তাঁরর সব সম্পদ এখনো রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে। গোপন সূত্রে জানা যায়, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তবে জুলাই আগষ্টে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য তিনি ময়মনসিংহে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত রেদুয়ান হাসান সাগর হত্যা মামলার আসামী হন।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে রাজাকারের অভিযোগ তুলে ময়মনসিংহ আদালতে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করিয়েছেন বাবুল। ওইসব মামলায় সাধারন নির্দোষ মানুষদের আসামি করার ভয় দেখিয়ে তার চেম্বারে ডেকে এনে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা।
ময়মনসিংহ মহানগর যুবদলের সভাপতি মোজাম্মেল হক টুটু বলেন, মোয়াজ্জেম হোনেস বাবুল আমার বড় ভাই ছাত্রনেতা শহীদ আনিসুল হক ইয়াহিয়া হত্যা মামলার আসামি ছিল। রাজনৈতিক আধিপত্যে বাঁধা হওয়ায় ১৯৮৬ সালের নগরীর জিলা স্কুল মোড় এলাকায় বাবুলের নেতৃত্বে ইয়াহিয়াকে হত্যা করা হয়। কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাবের কারণে আমি ভাই হত্যার বিচার পাইনি। এছাড়াও এই বাবুল অসংখ্য মানুষের সম্পদ জবরদখল করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এডভোকেট হান্নান খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী দোসরদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। একজন আইনজীবী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পযন্ত প্রভাব বিস্তার করেছেন। চাঁদাবাজি, দখলবাজী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে তিনি যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন, তা খুঁজে বের করার জন্য দুদুকের সক্রিয় ভূমিকা আশা করছি।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ময়মনসিংহ বিভাগ) আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ বলেন, এরা সরাসরি গনহত্যাকারী। অথচ পুলিশ এদের না ধরে চুনুপুটি ধরেই ক্লান্ত। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে পুলিশকে বলছি এসব বড় বড় আসামীকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার জন্য। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি তাদের খুজে না পায় তাহলে সেটা তাদের ব্যার্থতা।
এবিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম সাংবাদিকদের বলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল পলাতক আছেন। তাদের মতো আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা চলছে। জমি দখল সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
The post আ’লীগ নেতা মোয়াজ্জেম বাবুল ধরাছোঁয়ার বাইরে appeared first on দৈনিক ময়মনসিংহের খবর.