
অনলাইন ডেস্ক: ভোরের নতুন সূর্য ওঠার মাধ্যমে শুরু হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে নববর্ষকে বরণ করে নেওয়া হলো।
আজ সোমবার সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, দুই উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, কোষাধ্যক্ষ প্রমুখ অংশ নেন শোভাযাত্রায়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা–কর্মীরাও এতে অংশ নেন।
শোভাযাত্রায় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–শিক্ষার্থী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিরা অংশ নেন। সম্মুখভাগে ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) সুসজ্জিত ১৮টি ঘোড়া।
২৮টি নৃগোষ্ঠী, ব্যান্ডদল, বিশেষ অতিথিবৃন্দ, কৃষক দল, সাধু ও বয়াতি, জাতীয় নারী ফুটবল দল, ফ্যাসিবাদের মোটিফসহ অন্যান্য মোটিফ, রিকশা বহর, পুরান ঢাকার ৫টি ঘোড়ার বহরসহ সব শ্রেণি–পেশার মানুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেন।
এ বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় বহন করা হয়েছে ৭টি বড় মোটিফ,৭টি মাঝারি মোটিফ এবং ৭টি ছোট মোটিফ। বড় মোটিফের মধ্যে ছিল ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, মুগ্ধের পানির বোতল, কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, পালকি, শান্তির পায়রা।
মাঝারি মোটিফের মধ্যে ছিল সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ ১০টি, রঙিন চরকি ২০টি, তালপাতার সেপাই ৮টি, তুহিন পাখি ৫টি, পাখা ৪টি, ঘোড়া ২০টি, লোকজ চিত্রাবলীর ক্যানভাস ১০০ ফুট। ছোট মোটিফের মধ্যে ছিল ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ৮০ টি, বাঘের মাথা ২০০ টি, পলো ১০টি, মাছের চাঁই ৬ টি, মাথাল ২০টি, লাঙল ৫টি, মাছের ডোলা ৫টি।
শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া মানুষকে বৈচিত্র্যময় জলরং, সরা চিত্র, মুখোশ, পুতুল ইত্যাদি বহন করতে দেখা যায়। এসো হে বৈশাখ, শুভ নববর্ষ ইত্যাদি লেখা সংবলিত টিশার্ট পরে, প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেন অনেকে। শাড়ি-পাঞ্জাবি ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পোশাকে দেখা যায় অনেককে।
হাতে ন্যায্যতার; মিলনের নানা স্লোগান, কণ্ঠে নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার ঐতিহ্যবাহী নানা গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেন তাঁরা। শোভাযাত্রায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষেরা এসেছেন তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে, সঙ্গে বহন করেছেন তাঁদের জীবনযাপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন উপাদান।
শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া মানুষ এবারের নববর্ষকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখছেন। তাঁদের প্রত্যাশা আবহমানকালের মিলনের এ সংস্কৃতি সদা বহমান থাকবে।
তাঁরা মনে করছেন, প্রশাসনিক উদ্যোগ বড় হলেও আধুনিকতার বিষবাষ্পে মানুষের হৃদয়ে কমছে এ সংস্কৃতির আবেদন। তাঁদের প্রত্যাশা এ সংস্কৃতি মানুষের হৃদয়ে আরও বেশি প্রোথিত হবে।
শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিইও মাহবুবুল কবির বলেন, ‘এবারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন মোটিফ নববর্ষের এ আয়োজনকে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরেছে। বাঙালির আবহমানকালের সংস্কৃতিগুলোর মিলন ঘটেছে এখানে। শেকড়ের সন্ধানে মানুষ মিলিত হয় সংস্কৃতির এ শোভাযাত্রায়।
বাংলার যে বর্ষপঞ্জিকা হিসেব করে এ দেশের মানুষ কৃষিসহ বিভিন্ন কাজ করে আসছে, আধুনিকতার বিষবাষ্পে তা অনেকেই ভুলতে বসেছে। নববর্ষ উপলক্ষে আরেকবার মানুষ নিজেদের শেকড়কে হৃদয়ে ধারণ করতে শেখে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশির দশকের শিক্ষার্থী হাসিনা আক্তার বলেন, ‘নববর্ষ এলে আগে যে আমেজ দেখতে পেতাম তা এখন আর দেখতে পাই না। শোভাযাত্রায় আসার পথে পথে কত আয়োজন দেখতে পেতাম! গানে গানে, নৃত্যে নৃত্যে মানুষ বরণ করত শোভাযাত্রার এ আয়োজনকে। ঘরে ঘরে, বাড়িতে বাড়িতে ছিল আনন্দ।
এখন প্রশাসনিকভাবে নববর্ষ উদ্যাপনের উদ্যোগ বড় হয়েছে। কিন্তু আবহমানকালের এ সংস্কৃতির আবেদন জনপরিসরে কমেছে। এ সংস্কৃতির আমেজকে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার আরও সুযোগ আছে।’
চারুকলা থেকে শুরু বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা, অংশ নিয়েছে ২৮টি জাতিগোষ্ঠীচারুকলা থেকে শুরু বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা, অংশ নিয়েছে ২৮টি জাতিগোষ্ঠী
কলাবাগান থেকে আসা বয়োজ্যেষ্ঠ আফসানা আক্তার বলেন, ‘দিন যত এগোচ্ছে সবকিছুতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে। নানা পরিবর্তনের মাঝে বাঙালির নানা সংস্কৃতি আড়াল হয়ে যাচ্ছে। এসব পরিবর্তনের মাঝে আমাদের সংস্কৃতিতে টিকিয়ে রাখার প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। দৃশ্যমান এ ঢাকঢোলের বাইরে যেটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে এর প্রতি আবেগ অনুভূতিকে টিকিয়ে রাখা।’
The post বর্ণাঢ্য আয়োজনে আনন্দ শোভাযাত্রায় নববর্ষ বরণ appeared first on সোনালী সংবাদ.