
একজন প্রতিবাদী নাগরিকের কলমে ভয়ঙ্কর বাস্তবতার খোলা চিঠিঃ সবুজ ধানের মাঠ, শিশুর হাসি, আযানের ধ্বনি, পাখির কলতান—বাংলার প্রতিটি গ্রাম যেন এক একটা জীবন্ত সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক ভয়াল বাস্তবতা। এমন একটি গ্রামের কথা বলছি, যেখানে স্বাধীনতা নেই, আইনের শাসন নেই, বিচার নেই—আছে শুধু ‘সিন্ডিকেট’ নামক এক আধা-গোপন দানবের শাসন।
এই গ্রাম কেবল একটি নির্দিষ্ট এলাকা নয়, এটি আজ বাংলার অসংখ্য প্রান্তিক অঞ্চলের প্রতিচ্ছবি। এই গ্রামে আইন মানে সিন্ডিকেটের রায়, বিচার মানে ‘হাদিয়া’, আর প্রতিবাদ মানে—সর্বনাশ। রাষ্ট্র আছে, প্রশাসন আছে, সাংবাদিকতা আছে—কিন্তু কার্যত তারা সবাই যেন নিস্তব্ধ, প্রতিক্রিয়া-হীন দর্শক। আইনে গেলে হবে না”—এই বাক্যেই বন্দি মানুষের অধিকার! এই চক্রের প্রধান অস্ত্র হলো ভয় এবং নিয়ন্ত্রণ। গ্রামের যেকোনো পারিবারিক বিরোধ, জমি নিয়ে ঝামেলা, এমনকি মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রথমে হাজির হয় এই সিন্ডিকেট। এবং তাদের সেই চিরচেনা বাক্য—“আইনে গেলে হবে না, আমরা দেখছি!” অর্থাৎ বিচার হবে ‘যে বেশি দেবে’ তার পক্ষে। এটা শুধু অনৈতিক নয়, এটি সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড। আর যে কেউ যদি এই ‘চুক্তি’র বাইরে চলে যায়, কিংবা হাদিয়া না দেয়—তাকে একঘরে করে দেওয়া হয়। এই একঘরে করাটা যেন এক সামাজিক মৃত্যু পরোয়ানা, যাতে পরিবারও টিকে থাকতে পারে না।
জেলে-কৃষকের ওপর সন্ত্রাস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও দখলদারি! সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্রটি উঠে এসেছে সাম্প্রতিক একটি ঘটনায়, যেখানে সরকার-স্বীকৃত কার্ডধারী জেলেদের নদী থেকে অবৈধ ভাবে উচ্ছেদ করেছে এই চক্র। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে এসে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। কিন্তু তার পরদিনই সিন্ডিকেট প্রধান বহিরাগত লোক এনে, সেই নিরীহ জেলেদের জাল ও নৌকা ভাংচুর করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে পুনরায় নদী থেকে তাড়িয়ে দেয়। একই সাথে তারা দাবি করছে যে, গ্রামের এক মসজিদের নামে নাকি তারা পুরো নদী লিজে নিয়েছে। অথচ উপজেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে,এমন কোনো লিজ দেওয়া হয়নি। তাহলে কীভাবে তারা ধর্মের অপব্যবহার করে ধর্মীয় আবরণে নদী দখলের সাহস পেল? প্রশ্ন হচ্ছে, এই সিন্ডিকেট কি রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে? যেখানে সরকারি কর্মকর্তার আদেশ অমান্য করে প্রকাশ্য সন্ত্রাস চালানো হয়, সাংবাদিকদের লাঞ্ছনা করা হয়, কার্ডধারী পেশাজীবীদের রুটি-রুজি কেড়ে নেওয়া হয়—সেখানে প্রশ্ন ওঠে, এই চক্রটি কী রাষ্ট্রের চেয়ে বড়? তারা কী আইনের চেয়ে শক্তিশালী? প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করার সাহস কোথা থেকে আসে? এর পেছনে কি রাজনৈতিক ছত্রছায়া, না সরকারি অবহেলা?
এরা মুখে বলে, তারা এই দলের না, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছায়াতলে সুযোগ মতো রং বদলিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। প্রশাসনের নীরবতা কি অপরাধীদের মদত নয়? এই ঘটনার পরও এখনো পর্যন্ত কোনো দোষীকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। কেন? প্রশাসনের ভূমিকা কোথায়? সাংবাদিক নিগৃহীত, সরকারি নির্দেশ অমান্য, ধর্মীয় বৈষম্য তৈরি, নদী দখল, পেশাগত অধিকার হরণ—এত অপরাধের পরও কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? এই ধরনের চক্রকে দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা না হলে, ভবিষ্যতে তারা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে। তখন প্রশাসনের হাতও হয়তো পৌঁছাতে পারবে না তাদের কাছে। সমাজকে জাগাতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে—এটাই সময়! এই লেখা কোনো আবেগময় উপন্যাস নয়—এটি একটি ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিবেদন। এটি শুধুমাত্র এক গ্রামের নয়, এটি বাংলার হাজারো গ্রামের কণ্ঠস্বর।
প্রতিটি সচেতন নাগরিকের এখন প্রশ্ন তোলা দরকার—কেন একটি সিন্ডিকেট আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে? কেন নিরীহ মানুষ নিজেদের অধিকারের জন্য ভয় পাবে? কেন প্রশাসন নির্বিকার? কেন সাংবাদিককে,জেলেকে, কৃষককে লাঞ্ছিত হতে হবে? এই নীরবতা ভাঙতে হবে—অবিলম্বে! এখন আর সময় নেই চুপ করে বসে থাকার। সময় এসেছে,দোষীদের শনাক্ত করে প্রকাশ্যে আনার,স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা রাখতে বাধ্য করার,মিডিয়া ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসার,এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের! কারণ যদি এখন চুপ থাকি, তাহলে খুব শীঘ্রই দেশের আরও শত শত গ্রাম এই দানবীয় শাসনের অধীন চলে যাবে—আর তখন স্বাধীনতার গল্প আমরা শুধু পাঠ্য বইয়ে পড়ব, বাস্তবে নয়। পরিশেষে বলি: “ভয় নয়, প্রতিবাদই মুক্তির পথ। সিন্ডিকেট নয়, রাষ্ট্র ও আইন হোক সর্বোচ্চ ক্ষমতা।”
The post সিন্ডিকেটের শাসনে বন্দী গ্রাম: কোথায় রাষ্ট্র, কোথায় বিচার? appeared first on দৈনিক ময়মনসিংহের খবর.