পঞ্চাশ বছর বেদখলে ছিল দক্ষিণডিহির কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ জমি উদ্ধার হয়। এখানেই গড়ে উঠেছে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ থেকে এখানে ৩ দিনের মলো ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি ) অমিতাভ সরকার জমি উদ্ধার সম্পর্কে এক প্রতিবেদকন দাখিল করেন।
‘যে প্রক্রিয়ায় উদ্ধার হলো বিশ্বকবির শ্বশুর বাড়ী’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন—-খুলনার ফুলতলা উপজেলার একটি সমৃদ্ধ গ্রাম হচ্ছে দক্ষিণডিহি। এ গ্রামের বেণীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে মৃণালিনী দেবীর সাথে বিয়ে হয়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বেণীমাধব রায় চৌধুরীর বাড়িটির দূরত্ব প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার। বিশ্বকবির শ্বশুর বাড়িটি একটি পুরাতন দ্বিতল ভবন। ভবনটির নীচতলায় ৩ (তিন)টি কক্ষ এবং ওপরের তলায় ২ (দুই) টি কক্ষ আছে। সংস্কারের অভাবে ভবনটি অবস্থা জীর্ণপ্রায়। পুরাতন দ্বিতল ভবন এবং এর বিশাল প্রাঙ্গনসহ মোট ৮ দশমিক ৪১ একর সম্পত্তির মালিক ছিলেন বিশ্বকবির শ্বশুর বেনীমাধব রায় চৌধুরীর ছেলে নগেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে সম্পত্তির মধ্যে হতে ভবনসহ ৭ দশমিক ০৮ একর সম্পত্তি নগেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরীর ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী এবং বীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী এদের প্রত্যেকের নামে আট আনা অংশ হিসেবে ভাগ হয়। বিশ্ব কবির শ্বশুরের বংশীয়গণ পরবর্তীকালে স্থায়ীভাবে এদেশ ত্যাগ করার কারণে ভবনসহ মোট ৭ দশমিক ০৮ একর সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকা ভুক্ত হয় । মহামূল্যবান এই সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লক্ষ্যে ঐ গ্রামের এজাহার উদ্দিন, আকবর সরদার ও আব্দুর রউফ সরদার মোট ২ দশমিক ৩৯ একর কৃষি জমি অবৈধভাবে ভোগ দখল করতে থাকেন । অপরদিকে ভবনসহ ৩ দশমিক ৭৩ একর অর্পিত সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল পূর্বক ভোগ করতে থাকেন একই গ্রামের হারেজ বিশ্বাস, রুস্তম বিশ্বাস এবং তাহাদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন। অবৈধ দখল কারীগণ বিভিন্ন কাগজ-পত্র তৈরীর মাধ্যমে উক্ত সম্পত্তি ভোগ দখল করতে থাকেন। দেওয়ানী আদালতের একতরফা সোলেনামা ডিক্রি অনুযায়ী উক্ত অবৈধ দখলকারীগণ বিশ্বকবির শ্বশুর বাড়ীর সম্পত্তি অর্পিত হওয়া সত্ত্বেও ফুলতলা উপজেলা ভূমি অফিস থেকে নামপত্তন মামলায় নিজ নামে নামপত্তন করাতে সক্ষম হন। ফুলতলা উপজেলাবাসীর দীর্ঘ দিনের প্রাণের দাবি ছিল কবির শ্বশুর বাড়ীর সম্পত্তি অবৈধ দখলকারদের নিকট হতে উদ্ধার পূর্বক সেখানে একটি রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে বেশ ক’বার লেখালেখিও হয়েছে। জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফুলতলা খুলনা, বেগম শামীমা সুলতানা এর নির্দেশে লোকজনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ এবং দপ্তরে রক্ষিত কাগজ পত্রাদি পর্যালোচনা পূর্বক কবির শ্বশুর বাড়ীকে পর্যটন পল্লী হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন বিগত ১৯৯৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বরে দাখিল করেন। উক্ত প্রতিবেদনে সম্পত্তির বর্তমান অবস্থা এবং অবৈধ দখলকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করি। উপজেলানির্বাহী কর্মকর্তা, ফুলতলা নির্দেশক্রমে উক্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতে আমাকে সহায়তা করেন ৪ নং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক রাজা। জেলা প্রশাসক নির্দেশ এবং পরামর্শ মোতাবেক অবৈধভাবে ভোগ দখল কারীদের নাম পত্তন বাতিলের জন্য আমার আদালতের দুটি মিস কেস ধারা দায়ের করা হয়। শুনানীর দিন অবৈধ দখলকারীগণ তাদের স্বপক্ষীয় কাগজ পত্রাদিসহ শুনানীতে অংশ গ্রহণ করেন । শুনানীকালে তাদের দাখিলীয় কাগজ পত্রাদি পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনায় তাদের দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণিত না হওয়ায় উক্ত সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে মূল মালিকদের নামে রেকর্ডভুক্ত করি। ২ দশমিক ৩৯ একর কৃষি সম্পত্তি দখল ১৯৯৫ সালের ৬ আগস্ট সরকারের অনুকূলে গ্রহণ করা হয়। অপর অবৈধ দখলকারীগণ বিশ্বকবির শ্বশুর বাড়ীর ভবনসহ মোট ৩ দশমিক ৩ একর অর্পিত সম্পত্তি দখল করায় তাদের উচ্ছেদ করা ছিল একটি জটিল প্রক্রিয়া । জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ একাধিকবার উক্ত বাড়িটি পরিদর্শন করেন । ঘন ঘন পরিদর্শনে অবৈধ দখলকারদের মনে দূর্বলতার সৃষ্টি হয় । অবৈধ দখলকারদের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। জেলা প্রশাসকের পরামর্শ মোতাবেক উপজেলানির্বাহী কর্মকর্তা এবং খুলনা সদর ভূমি কর্মকর্তা অবৈধ দখলকারদের বাড়িটি সরকারের অনুকূলে হস্তান্তর করবার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিশ্ব কবির শ্বশুর বাড়ির ভবনে অবৈধভাবে বসবাসরত হারেজ বিশ্বাস এবং রুস্তম বিশ্বাস বাড়িটির দখল সরকারের অনুকূলে হস্তান্তর করতে সম্মত হন বিনিময়ে তারা পুনর্বাসনের দাবি জানান। জেলা প্রশাসক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে উক্ত হারেজ বিশ্বাস এবং রুস্তম বিশ্বাসকে পুনর্বাসিত করা হয় এবং দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর বিগত ১৯৯৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে উপজেলানির্বাহী কর্মকর্তা সরকারী অনুকূলে দখলে নেন। শুরু হয় এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের একটি প্রাণের দাবির স্বার্থক বাস্তবায়ন। বিশ্ব কবির প্রতি এলাকাবাসী এবং প্রশাসনের শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ এ সম্পত্তিতে বিগত ১৯৯৫ সালের ১৪ নভেম্বর দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স এর উদ্বোধন করা হয়।
খুলনা গেজেট/এএজে
The post যেভাবে উদ্ধার হলো রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ি appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.