বিশেষ প্রতিনিধি:

দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে মাছ ধরার জন্য সম্প্রতি বাঁশের তৈরি বিশালাকৃতির চাঁই বা ফাঁদ ব্যবহার বেড়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ছে পাঙ্গাস মাছের পোনা।

ফলে এই মাছের প্রজনন ও সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে অবাধে পোনা শিকার চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পাঙাসের প্রজাতি হুমকির মুখে পড়তে পারে।

মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, ইলিশ রক্ষার অংশ হিসেবে মার্চ থেকে মে— এই দুই মাস মেঘনাসহ বিভিন্ন নদীতে মাছ ধরা পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকে। এ সময়টাতেই পাঙ্গাস মাছ নদীতে নিরাপদে ডিম দেয় ও প্রজনন করে। ডিম থেকে ফোটার পর পোনা নদীর গভীর পানিতে ঘুরে বেড়ায় এবং খাবার খেয়ে দ্রুত বড় হতে থাকে। 

স্বাভাবিকভাবে পাঙ্গাস খুব দ্রুত বড় হয়— আগস্টের মধ্যে একেকটি মাছের ওজন হয় ৫ থেকে ৬ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু কিছু অসাধু জেলে নিষিদ্ধ সময়ে গোপনে বিশাল আকৃতির চাঁই বা ফাঁদ বসিয়ে এসব পোনা আগেভাগেই ধরে ফেলছে। ফলে বড় হওয়ার আগেই নদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ পোনা, যা পাঙাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি করেছে। 

জেলা মৎস্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলাধীন মেঘনা নদীতে বড় আকারের চাঁই ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। উপজেলা মৎস্য অফিস ও স্থানীয় প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালালেও এসব ফাঁদ পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে শুরু হয়েছে প্রচার কার্যক্রম। মৎস্যসম্পদ রক্ষার গুরুত্ব ও পোনা নিধনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে নানা সভা ও কর্মশালা আয়োজন করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের আশা, এই সচেতনতা বাড়লে জেলেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের অবৈধ ফাঁদ ব্যবহার বন্ধ করবে। 

হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ এলাকার জেলেরা জানান, বিশালাকৃতির এই চাইগুলো বরিশালে তৈরি হয় না। এগুলো আসে মুন্সীগঞ্জ, ভোলার চরফ্যাশন ও মনপুরা এলাকা থেকে। চাঁইগুলোর উচ্চতা ৭ থেকে ৮ ফুট এবং প্রশস্ত প্রায় ১৫ ফুট— যা কিনতেও হয় চড়া দামে। 

এই ফাঁদগুলো ফেলা হয় নদীর সবচেয়ে গভীর অংশে, যেখানে পানির গভীরতা থাকে ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত। এমন গভীর স্থানে থাকা চাইয়ে বিপুল সংখ্যক পাঙ্গাস পোনা আটকে পড়ে, যা সহজে চোখে পড়ে না এবং অভিযানে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। ফলে পোনা নিধন প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে যাচ্ছে। 

স্থানীয় জেলে সেলিম ব্যাপারী জানান, নদীতে ফেলার আগে চাইয়ের ভেতরে শুঁটকি, খৈল, কুড়া ইত্যাদি দিয়ে তৈরি এক ধরনের মন্ড বা খাবারের মিশ্রণ রাখা হয়। এই মিশ্রণ থেকে ঘ্রাণ বের হয়, যা পাঙ্গাস মাছের পোনাদের আকৃষ্ট করে। ঘ্রাণে টান পড়ে পোনারা ঘুরতে ঘুরতে চাইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং আর বের হতে পারে না।  

তিনি জানান, সময়ভেদে একেকটি চাইয়ে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ কেজি পর্যন্ত পাঙাসের পোনা ধরা পড়ে। তবে বিপুল পরিমাণে ধরা এই পোনাগুলো বাজারে ‘টেংরা’ মাছ বলে বিক্রি করা হয়— যার বেশিরভাগই ক্রেতা বোঝেও না যে এগুলো আসলে অসময়ে ধরা পাঙাসের শিশু মাছ। 

বরিশালের হিজলা উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি মো. বাশার জানান, এই বিশালাকৃতির চাঁই এত বড় যে চাইলে এর ভেতরে দুই-তিনজন মানুষও ঢুকতে পারে। একটি চাঁই নদীতে ফেলার আগে এতে শুঁটকি, খৈল, কুড়া মিলিয়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার খাবার ভরা হয়, যেন পোনারা সহজে আকৃষ্ট হয়। আর যখন সেই চাঁই নদী থেকে তোলা হয়, তখন একেকটিতে আড়াই থেকে তিন মন (প্রায় ১০০-১২০ কেজি) পাঙাসের পোনা উঠে আসে। এই চরম লাভের আশায় অনেক জেলে নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে নিষিদ্ধ এ ফাঁদ ব্যবহার করছে। 

জেলে সমিতির সভাপতি মো. বাশার আরও বলেন, এভাবে মাছ ধরতে আমরা অনেকবার নিষেধ করেছি, কিন্তু কেউ শুনতে চায় না। প্রশাসনও নিয়মিত অভিযান চালিয়েছে, বহু চাঁই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন হিজলায় এসব দৈত্যাকার চাঁই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পাশের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় এখনো অবাধে এই চাঁই ব্যবহার চলছে। 

অপরদিকে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি মো. পলাশ জানান, মেঘনা নদীর হিজলা সংলগ্ন এলাকায় এখনো কিছু জেলে দৈত্যাকার চাঁই ব্যবহার করে মাছ ধরছে। 

তিনি বলেন, শুনেছি তারা পাঙাসের পোনাসহ কিছু ভালো মাছও পাচ্ছে। এসব মাছ ঢাকা ও বরিশালের বাজারে নিয়ে বিক্রি করলে ভালো দাম মেলে। এটাই মূলত তাদের উৎসাহিত করছে। তাই অভিযান বা নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গোপনে চাঁই ব্যবহার থেমে নেই। 

পলাশ জানান, এভাবে চলতে থাকলে শুধু পাঙ্গাস নয়, অন্যান্য মাছের প্রজাতিও সংকটে পড়বে। সময় থাকতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে নদী থাকবে, কিন্তু মাছ থাকবে না। 

বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম জানান, পাঙ্গাস মাছ সাধারণত নদীর গভীর অংশে— ৪০ থেকে ৫০ ফুট নিচে বাস করে। এর পোনারাও একইভাবে গভীর পানিতে থাকে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসাধু জেলেরা বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশাল চাঁই ব্যবহার করে পোনা ধরে ফেলে। 

তিনি বলেন, এভাবে পোনা ধরা চলতে থাকলে খুব দ্রুতই নদী থেকে পাঙ্গাস মাছ বিলীন হয়ে যাবে। 

মোহাম্মদ আলম জানান, এসব অনিয়ম ঠেকাতে মৎস্য বিভাগ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। গত এক মাসেই মেঘনা নদীতে ফেলার জন্য আনা ৬টি বিশাল চাঁই উদ্ধার করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। 

তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি এখনই কঠোরভাবে চাঁই ব্যবহার বন্ধ করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো নদী থেকে পাঙ্গাস মাছও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।  

The post দৈত্যাকার চাঁইয়ে পাঙ্গাসের ভবিষ্যৎ শঙ্কা appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.