বরগুনা প্রতিনিধি:

বরগুনায় মহামারি আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এ অবস্থায় হাসপাতালে রোগীদের বার্তি চাপে পরীক্ষা সঙ্কটে বেশিরভাগ রোগী ছুটছেন বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
তবে এসব পরীক্ষায় একের পর এক ভুল রিপোর্ট ধরা পড়ায় চিকিৎসা দিতে বিপাকে পড়ছেন চিকিৎসকরা। অপরদিকে একই পরীক্ষা বারবার করায় বাড়তি টাকা খরচের ভোগান্তি ভুক্তভোগীদের।
সরেজমিনে বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি বেডের বিপরীতে প্রায় দেড় শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদের মধ্যে গত তিন দিন আগে ৯৩ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বরগুনা সদর উপজেলার খেজুরতলা নামক এলাকার বাসিন্দা মো. সাগর। এর এক দিন পর ১৬ জুন হাসপাতালের বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি পরীক্ষা করেন।
এ সময় ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দেওয়া রিপোর্টে সাগরের মাত্র ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয়। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকদের সন্দেহ হলে পূনরায় পরীক্ষা করতে বললে একই দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি ক্লিনিকের পরীক্ষায় সাগরের প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয় ১ লাখ ৪৯ হাজার।
ভুক্তভোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সাগর বলেন, ডাক্তারকে শারীরিক অবস্থা জানাতে বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করি। সেখান থেকে আমার ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করে রিপোর্ট দেওয়া হয়। রিপোর্ট দেখে আমি ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে বরিশাল যেতে চাই। এ ছাড়া ভয়ে আমার বুক কাঁপা শুরু করে। পরে ওই রিপোর্টটি ডাক্তারকে দেখালে রিপোর্টে ভুল হয়েছে জানিয়ে আবারও পরীক্ষা করতে বলেন। পরবর্তী অন্য একটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করলে ১ লাখ ৪৯ হাজার প্লাটিলেট আছে এমন রিপোর্ট দেওয়া হয়।
ফোরকান নামে সাগরের এক মামা বলেন, বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সোহাগের পরীক্ষায় ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করে রিপোর্ট দেয়। তবে ওই রিপোর্ট ভুল হয়েছে বলে ডাক্তার আবারও পরীক্ষা করতে বলেন। আমারা এমনিতেই রোগী নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির মধ্যে থাকি। এরপর আবার ভুল রিপোর্টের কারণে এক পরীক্ষা বারবার করে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সাগর নয় আরও অনেকেরই পরীক্ষার রিপোর্ট ভুল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন রোগী ও স্বজনদের। খেজুর তলা এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম নামে আরও এক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গেও ঘটেছে এমন ঘটনা। তিনি গত শুক্রবার ৬৭ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরদিন স্থানীয় অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে তার প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার। তবে এক দিনের ব্যবধানে এমন রিপোর্ট দেখে সন্দেহ হয় চিকিৎসকের। পরে আরেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে প্লাটিলেট দেখায় ৫৪ হাজার।
এর আগে গত ১১ জুন একই ক্লিনিক থেকে ১০ বছর বয়সী তানিয়া নামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এক শিশুর পরীক্ষায়ও দেওয়া হয় ভুল রিপোর্ট। ক্লিনিকের দেওয়া রিপোর্টে তার প্লাটিলেট দেখায় ১৮ লাখ ৯৫ হাজার। ভুক্তভোগী মরিয়ম বলেন, পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডাক্তার আমাকে আবারও পরীক্ষা করতে বলেছেন। কি হয়েছে বা না হয়েছে আমি তা বলতে পারি না।
হাসপাতালে ভর্তি ১৩ বছর বয়সী মুসা নামে এক রোগীর স্বজন মো. আব্দুস সালাম বলেন, সোমবার প্রথমে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করলে ৪৭ হাজার প্লাটিলেট পাওয়া যায়। পরে একই সময়ে আরেকটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করালে ৮৯ হাজার প্লাটিলেটের রিপোর্ট দেওয়া হয়। একেক ক্লিনিকের একেক ধরনের রিপোর্ট, কোন রিপোর্টটি সঠিক তা আমরা কিভাবে বুঝবো।
ভুল রিপোর্ট রোগীকে প্রদান করার বিষয়ে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালীক সজীব বলেন, টাইপিং ভুলের কারণে রিপোর্ট ভুল হতে পারে। তবে এসব ভুল অনিচ্ছেকৃতভাবে হয়েছে।
বরগুনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের মেশিনটি দামি। বাইরের ক্লিনিকগুলোতে যে মেশিন রয়েছে তা কম দামের এবং অনেক নিম্নমানের।
সে কারণে বাইরে থেকে অনেক সময় সঠিক রিপোর্ট আসে না। যদি হাসপাতালেই রোগীদের এ পরীক্ষাটি করা হয় তাহলে রোগীরা সঠিক রিপোর্ট এবং সঠিক চিকিৎসা পাবে। এ ছাড়া রোগীদের হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি তাদের বাড়তি টাকাও খরচ হবে না।
বরগুনার বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মানোন্নয়নে নিয়ন্ত্রণকারী দপ্তরকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাসপাতালে দায়িত্বরত মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. আশিকুর রহমান বলেন, রিপোর্ট নিয়ে আমাদের চিন্তায় পড়তে হয়।
কিছু কিছু রিপোর্ট দেখেই তা অসামঞ্জস্য মনে হয়। তখন আমরা রোগীকে কষ্ট হলেও আরেকবার আরেক জায়গায় পুনরায় পরীক্ষা করতে বলি। তবে এতে রোগীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়।
আমাদের হাসপাতালে পরীক্ষা হয় তবে অতিরিক্ত রোগীর চাপে ভীড় এড়াতে অনেকেই বাইরে থেকে পরীক্ষা করেন। প্লাটিলেট যেহেতু আমরা চোখে দেখি না তাই রিপোর্টটের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা দিতে হয়। তবে আমরা আগের রিপোর্টের সঙ্গে বর্তমান রিপোর্ট মিলিয়ে দেখে যদি খুব বেশি পার্থক্য আসে তাহলে রোগীকে আবারও পরীক্ষা করতে বলি।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে সিভিসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ভর্তি থাকায় শুধু ইনডোরের রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। আশা করি, খুব দ্রুতই বেশি পরিমাণ পরীক্ষা হাসপাতালেই করা যাবে। তবে বাইরের ক্লিনিক থেকে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট হলে রোগীর চিকিৎসা করাটাও চিকিৎসকের জন্য বিপদজনক।
The post বরগুনায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্ট, ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে বিপাকে চিকিৎসকরা appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.