
বন্যা, বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়া
সোনালী ডেস্ক: সম্প্রতি বন্যা, নদীর পানি বৃদ্ধি, বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের নানা জেলায় ধান ও শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলে তৈরি হয়েছে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি, আর দমকা হাওয়ার ফলে জমিতেই নুইয়ে পড়েছে ধানগাছ। বৃষ্টির পানিতে ডুবছে ধানের ছড়া। একইসঙ্গে নষ্ট হতে শুরু করেছে শীতকালীন সবজিও। চাষিরা বলছেন, সামনের দিনে যদি আবহাওয়া ভালো না হয়, তাহলে বাকি ফসলও বাঁচানো যাবে না। তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।
ফসলের পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথা হয় নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর এলাকার কৃষক আমজাদ আলীর। তিনি জানান, সপ্তাহ তিনেক পরই ধান কাটবেন বলে মনস্থির করে রেখেছিলেন। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ায় সেই ইচ্ছেতে ছন্দপতন হয়েছে। কৃষক আমজাদ জানান, চলতি বছর আড়াই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় দুই বিঘা জমিরই ধানগাছ পড়ে গেছে পানিতে। এসব গাছ আর নিজে থেকে দাঁড়াতে পারবে না। ফলে পানিতে পচে নষ্ট হয়ে যাবে।
একই অবস্থা নওগাঁর ১১ উপজেলার ফসলের মাঠগুলোতে। অধিকাংশ জমির ধান নুইয়ে পড়েছে। যদিও এখন আর বৃষ্টি নেই, আবহাওয়াও অনুকূলে, তারপরও চাষিরা বলছেন, যেসব ধানগাছ একবার পড়ে গেছে, সেসব একেবারে শেষ। পানিতে পচে নষ্ট হয়ে যাবে। অনেক চাষি আবার ক্ষতি কিছুটা কমাতে তাদের জমির পড়ে যাওয়া ধান গাছগুলো আঁটি করে বেঁধে দিচ্ছেন। ধানের পাশাপাশি ক্ষতি হয়েছে সবজি ক্ষেতেরও। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে মরে যাচ্ছে সবজির চারা। বিশেষ করে শীতকালীন সবজির মধ্যে বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, মুলা, লাল শাক ও পালং শাকসহ শীতকালীন যেসব সবজি রয়েছে, সবকিছুর ক্ষতি হয়েছে।
চাষিরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, সামনের দিনে যদি আবহাওয়া ভালো না হয়, তাহলে বাকি গাছগুলো বাঁচানো যাবে না। এরইমধ্যে বৃষ্টির কারণে পাতা ও কাণ্ডপচা রোগে আক্রান্ত হয়ে সবজি চারা মরে যাচ্ছে। তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক খলিলুর রহমান জানান, বৃষ্টিতে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না ধানের। কারণ ধানের জন্য বৃষ্টি কিছুটা উপকার করে। তবে যদি বাতাসের কারণে গাছ পড়ে যায়, তাহলে ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের জেলায় গত কয়েকদিনে মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেক্ষেত্রে ফসলের ক্ষতি হওয়ার তেমন কোনো শঙ্কা নেই।
খলিলুর রহমান বলেন, ধানের ক্ষেত্রে আমরা চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছি। যাদের ধান গাছ পড়ে গেছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে সেগুলো আঁটি করে বেঁধে দিতে হবে, যাতে করে মাটিতে পড়ে না থাকে এবং পানির সংস্পর্শে না থাকে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে ফসলের ক্ষতি হবে না। তিনি বলেন, সবজির জন্য আমরা কৃষকদের জানাচ্ছি, সবজি ক্ষেতে পানি জমে থাকলে দ্রুত পানি নিষ্কাশন করতে হবে এবং কাণ্ডপচা রোগের জন্য আমরা বেশ কয়েকটি ওষুধ স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি। চলতি মৌসুমে নওগাঁয় রোপা আমন ধানের আবাদ হয়েছে এক লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে। আর তিন হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে শীতকালীন সবজি।
রাজশাহী জেলারও বেশ কিছু এলাকায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এটিকে ক্ষতি বলতে নারাজ। তবে সম্প্রতি পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের কৃষক ফজর মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলন ভালো আশা করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ অবিরত বৃষ্টি ও বাতাসে ধান খেত নুয়ে গেছে। আরেক কৃষক আব্দুল মতিন জানান, তিনি ছয় একর জমিতে আমন ধান চাষ করেছিল। দুই একরে চিনিগুড়া ও চার একরে রঞ্জিত জাত। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার অনেক ভালো ফলন হয়। কিন্তু দুই দিনের বৃষ্টির কারণে কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তোলা নিয়ে তিনি চিন্তিত। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক উম্মে সালমা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত সেপ্টেম্বরে যে বৃষ্টি হয়েছে, তা ফসলের জন্য উপকারি। ঝড়ো বাতাসেও খুব একটা ক্ষতি হয়নি। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।
গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দুর্গাপুর উপজেলায় গুড়ি গুড়ি ও ভারী বৃষ্টিতে কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা রাস্তা-ঘাট, পানবরজ, সবজি খেতসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, সব্জিখ্যাত জয়নগর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া, বড়গাছি, বেড়া, গগনবাড়ীয়া, বাজুখলশী, কিশোরপুর এলাকার সবজি চাষিরা শীতকালীন ফুলকপি, বাঁধাকপি, সিম, লাউ সহ আগাম শাকসবজি চাষ করেছেন। সেপ্টেম্বরের টানা বৃষ্টিতে প্রতিটির জমিতে পানি বেঁধে যাওয়ায় এবং পানি নিষ্কাশনের পথ না পাওয়ায় গাছগুলো প্রায় মরতে বসেছে। এতে ধরাশায়ী হয়ে গেছেন ওই এলাকার শতশত সব্জিচাষী।
এতে এলাকার কৃষকদের প্রায় ২কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে বলে জানান চুনিয়া পাড়া গ্রামের সব্জি চাষি নয়ন আলী। পৌর এলাকার সিংগা গ্রামের কৃষক আরিফুল ইসলাম জানান, দেড় বিঘা জমিতে আগাম পেঁয়াজ রোপনের জন্য জমি তৈরি করেছেন এবং ১০ কাঠা জমিতে রোপন করেছিলেন। সেপ্টেম্বরের টানা বৃষ্টিতে তৈরিকৃত জমি নষ্ট হয়ে গেছে, এই জমিতে আগামী ১৫ দিনেও পেঁয়াজ রোপনের উপযোগী হবে না। আর রোপনকৃত পেঁয়াজের জমিতে বৃষ্টির পানি বেঁধে থাকার কারণে তা পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে। এতে তার প্রায় লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তার।
ফসলের ক্ষতি হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জেও। জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনটি নদীর পানি বেড়ে ফসল নিমজ্জিত হওয়ায় কৃষকের প্রায় ৪৯ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাসকলাই চাষীরা। অক্টোবরের শুরুতে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই প্রতিবেদনটি ঢাকার খামারবাড়িস্থ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়েও পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব ক্ষতি হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেলার প্রধান তিনটি নদী পদ্মা, মহানন্দা ও পূনর্ভবার কোনটির পানি বিপদসীমা অতিক্রম না করলেও নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নদীর চর এবং নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের ফসলি জমি প্লাবিত হওয়ায় মাসকলাইসহ অন্যান্য ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্য ইতোমধ্যে পদ্মা, মহানন্দা ও পূনর্ভবা নদীতে পানি কমতে শুরু করেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পানিতে নিমজ্জিত হয়ে জেলায় ১৯৩২ হেক্টর জমির মাসকলাই, ৯ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, ৫ হেক্টর জমির রোপা আউশ, ৪০ হেক্টর জমির বিভিন্ন সবজি ও ৩ হেক্টর জমির চিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৬ হাজার ৮১০ জন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার মাসকলাই চাষীরা। জেলায় মোট ফসলের ২.৭৪ শতাংশ ফসল দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
মাসকলাইয়ে ক্ষতির আর্থিক মূল্য ধরা হয়েছে ৪৫ কোটি ৯৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া জেলায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা, সবজিতে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা, রোপা আউশে ১০ লাখ ৮ হাজার টাকা ও চিনাতে ২ লাখ ২ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৪৯ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা। সম্ভাব্য উৎপাদিত ফসলের সম্ভাব্য মূল্য হিসেবে আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সদর উপজেলার আলাতুলি, শাহজাহানপুর, বারোঘরিয়া, চরবাগডাঙ্গা, শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর, পাঁকা, ছত্রাজিতপুর, দুর্লভপুর, ঘোড়াপাখিয়া, মনাকষা, গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর, চৌডালা, রাধানগর, বোয়ালিয়া, বাঙ্গাবাড়ি ও আলীনগর ইউনিয়নকে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারের নিয়মিত প্রণোদনার আওতায় আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ আসলে সেগুলো কৃষকদের সময়মতো বুঝিয়ে দেয়া হবে।
অক্টোবরের শুরুতে বগুড়া জেলাতেও শীতকালীন শাকসবজিসহ নানা ফসলের ক্ষতির খবর পাওয়া যায়। জানা যায়, জেলার সারিয়াকান্দির যমুনা এবং বাঙালি নদীতে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পানি বৃদ্ধির কারণে যমুনায় জেগে ওঠা ডুবোচরগুলো ফের ডুবতে শুরু করে। পানিতে নিমজ্জিত হয় রোপণ করা স্থানীয় জাতের গাইঞ্জা ধান গাছ। হুমকিতে পড়ে আগাম রোপণ করা মরিচ, মাষকলাই এবং মিষ্টিকুমড়াসহ শীতকালীন শাকসবজি।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর যমুনা এবং বাঙালি নদীর অববাহিকায় জমা পলিমাটিতে কৃষকরা স্থানীয় জাতের গাইঞ্জা ধান রোপণ শুরু করেছিলেন। জমিতে মরিচ, মিষ্টিকুমড়া, মাষকলাইসহ বিভিন্ন ধরনের আগাম শীতের শাকসবজির চাষও করেছিলেন। অসময়ে পানি বৃদ্ধির ফলে সেপ্টম্বরের শেষের দিকে রোপণ করা স্থানীয় জাতের গাইঞ্জা ধান পানিতে নিমজ্জিত হওয়া শুরু হয়।
The post রাজশাহীসহ উত্তররের বিভিন্ন জেলায় ফসলের ক্ষতি appeared first on সোনালী সংবাদ.