নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে হুটহাট রাজপথে নামছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এতে তৈরি হচ্ছে জনদুর্ভোগ। দাবি আদায় করতে গিয়ে পরিস্থিতি সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে জনভীতি। বিশেষ করে ঢাকায় রাজপথ দখল করে একের পর এক কর্মসূচি পালনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি গাজীপুর ও আশুলিয়ায় শ্রমিকঘন অঞ্চলে মহাসড়ক অবরোধের পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি নানা ইস্যুতে দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও সংঘাতে জড়িয়েছেন ঢাকার একাধিক নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এর আগে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা দফায় দফায় রাজপথ অবরোধ করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
ভুক্তভোগী ছাড়াও অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনশৃঙ্খলা ফেরাতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে নৈরাজ্য মোকাবিলা করা কঠিন। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পক্ষ থেকেও নাগরিকদের আরও দায়িত্বশীল আচরণে সহযোগিতা চাওয়া হয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ঢাকায় নানা দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা ঘটছে। এটি মোকাবিলায় জোরালো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথাও সরব, আবার কোথাও নীরব। দিনক্ষণ ও স্থান ঘোষণা দিয়েও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কেউ কেউ এসবের ভেতর ইন্ধনের কথা বলছেন। গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে ঘটনার পেছনেও কোনো ঘটনা রয়েছে কিনা।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন অধিকারকেন্দ্রিক আন্দোলন ও দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। তবে আন্দোলন যৌক্তিক কাঠামোর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে উন্মাদনা ভালো ফল আনে না। এসবের বিরুদ্ধে জোরালো ও কঠোর বার্তা দেওয়া জরুরি। সংঘাত-সহিংসতায় জড়ালে কারও পরিচয় মুখ্য নয়, যে হোক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবার কেউ কেউ জনদুর্ভোগ ঘটিয়ে দাবি-দাওয়া আদায় করার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া বাড্ডার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক ছাত্র চিকিৎসা অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ ঘিরে তুলকালাম ঘটনা ঘটে। ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা একত্র হয়ে প্রথমে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ এবং ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ও কলেজে হামলা-ভাঙচুর করে। পরে আগাম ঘোষণা দিয়ে সোমবার সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়ান। লন্ডভন্ড করা হয়েছে মোল্লা কলেজ।
এ ব্যাপারে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের অধ্যক্ষ মো. ওবায়দুল্লাহ নয়ন বলেন, অকল্পনীয় এই সংঘাতে ছাত্রদের কেউ ব্যবহার করেছে কিনা, নিশ্চয় গোয়েন্দারা তা বের করবে। আগের দিন ঘোষণা দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে। সব তছনছ করা হয়েছে। প্রশাসনকে বিষয়টি আগেভাগে জানানোর পরও সময়মতো কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। যখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী হাজির হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অনেক ছাত্র এখন সামান্য বিষয় নিয়ে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। তারা শিক্ষক ও অভিবাবকদের কথা শুনতে চায় না। আমরা মেসেজ দিয়ে, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি সামাল দেওয়ার কথা বলে ব্যর্থ হয়েছি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, ধীরে ধীরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে ছাত্র-শিক্ষক, গণমাধ্যমসহ সবার ভূমিকা আছে। নিজের স্বার্থে একজনকে ছোট করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা কিছু লিখে দেওয়ার যে মনোবৃত্তি, এখান থেকে বের হতে না পারলে ঘৃণা বাড়বে।
তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘাত ছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের লতিফ হলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একই সঙ্গে কয়েক দিন ধরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক ও মালিকরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছেন। সোমবার ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে ফের সড়ক অবরোধ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা।
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, প্রত্যাশা থাকবে, নাগরিক জীবন বিপন্ন হোক এমন কোনো পরিস্থিতি যাতে না ঘটে। নগরবাসীকে বিপাকে ফেলে কারও কর্মসূচি প্রত্যাশিত নয়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর প্রথমে কিছুদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন এলাকার রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সচিবালয়ে আনসার সদস্যদের বিক্ষোভও ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এমন পরিস্থিতিতে ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার আশপাশে যে কোনো ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে দাবি-দাওয়া জানানো হচ্ছে। ঘর থেকে বের হলেই আকস্মিক বিপাকে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় যানজটে আটকা পড়ছেন তারা। রাস্তাঘাট বন্ধ করে অন্যদের জিম্মি করার মধ্য দিয়ে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা দাবি আদায় বা চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে মনে করছেন অনেকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, সবাইকে ধৈর্যশীল ও সহনশীল আচরণ করতে হবে। কোনো দাবি থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক মাধ্যমে উপস্থাপন করা যেতে পারে। চলমান পরিস্থিতি পুলিশ আইনের প্রতি যত্নশীল হয়েই দায়িত্ব পালন করছে।
খুলনা গেজেট/এইচ
The post হুটহাট সংঘর্ষ, বিক্ষোভ : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.