5:41 pm, Wednesday, 27 November 2024

মঠবাড়িয়ায় শব্দ শুনে মোটরসাইকেল মেরামত করেন দৃষ্টিশক্তিহীন হোসেন আলী

মঠবাড়িয়া ((পিরোজপুর) প্রতিনিধি:

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলী। প্রায় দশ বছর আগে ব্রেন স্ট্রোকের পরে চোখে সমস্যা দেখা দেয় তার। চিকিৎসার অভাবে তার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যায়। অন্ধত্ব বরণ করে নিতে হয় তাকে।

তবে ৫০ বছর বয়সেও এই অন্ধত্ব দমাতে পারেনি হোসেন আলীকে। অন্ধ হয়েও শব্দ শুনেই সমস্যা বুঝে দিব্যি মেরামত করে ফেলেন মোটরসাইকেল। তার কাজ দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তিহীন।

এমনকি টাকা হাতে নিয়েই বুঝে ফেলতে পারেন কোনটা কত টাকার নোট। স্বল্প খরচে ভালো কাজ করেন বলেই মেকানিক হিসেবে এলাকায় রয়েছে তার বেশ কদর।

৯ বছর বয়সে ভাইয়ের দোকানে মোটরসাইকেল ও জেনারেটর মেরামতের হাতেখড়ি হোসেন আলীর। এরপর ধীরে ধীরে মেকানিকের কাজ রপ্ত করে ফেলেন তিনি। তখন থেকেই যন্ত্র চলার শব্দ শুনেই সমস্যাগুলো ধরে ফেলতেন এবং সেগুলো মেরামতে কাজ করতেন।

দশ বছর আগে তার ব্রেন স্ট্রোকের পরে চোখে সমস্যা দেখা দেয়। অর্থাভাবে করাতে পারেনি চিকিৎসা। ফলে হারাতে হয় দৃষ্টি শক্তি। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে তার পিছু হাঁটতে হয়নি।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া পৌরশহরের কে এম লতিফ সুপার মার্কেটে ছোট্ট একটি দোকান ভাড়া নিয়ে আবারও মেকানিকের কাজ করা শুরু করেন। কারো অনুদান কিংবা সাহায্যে নেননি। বছরে দুইবার চোখের সমস্যার জন্য ৩৫ হাজার টাকা করে এক একটি ইনজেকশন নিতে হতো তার। তিনটি নেওয়ার পরে আর নিতে পারেননি তিনি।

এদিকে স্ত্রী সালমা বেগমের একটি কিডনি নষ্ট। তার জন্যও করতে হয় ব্যয়বহুল চিকিৎসা। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে হোসেন আলীর পরিবার। সরকার থেকে প্রতি তিন মাস পর পর ২ হাজার ৫শ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও সেটা দিয়ে সংসার চলে না তার। নিজ জীবনের গল্পটা এভাবেই ঢাকা পোস্টকে জানাচ্ছিলেন অন্ধ মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলী।

হোসেন আলী বলেন, এখন আগের মতো আয় রোজগার নেই সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। দৈনিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করলেও কোনো কোনো দিন খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। এখন সরকার যদি সাহায্য করতেন আমি তা মাথা পেতে নিতাম।

মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলীর ছেলে মো. তুহিন বলেন, আমার বাবা ২০১৫ সালের শেষ দিকে ব্রেন স্ট্রোক করেন এরপর থেকে তিনি চোখে দেখেন না। আমার বাবা আমারও ওস্তাদ। কোনো কাজেই তিনি দমে থাকেনি।

যেকোনো কাজ তিনি শব্দ শুনে করতে পারেন। আমাদেরকেও বলেন এখানে এখানে সমস্যা, আমরা সেভাবে কাজ করি। সরকারের কাছে আমাদের একটাই আবেদন আমাদের আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো না যে আমরা বাবার চিকিৎসা করব।

প্রথমে টাকা পয়সা যা ছিল চিকিৎসায় শেষ হয়ে গেছে এখন সরকারের কাছে দাবি সরকার যদি আমাদেরকে কিছু সাহায্য করতো তবে আমরা তার চিকিৎসা করাতে পারতাম।

মঠবাড়িয়া পৌরশহরের কে এম লতিফ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. রিপন বলেন, আমি দীর্ঘদিন মোটরসাইকেল পার্টসের ব্যবসা করি। সেহেতু মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলীর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়।

হোসেন আলী ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে ঢাকা থেকে মঠবাড়িয়ায় আসে এখানে যতজন মেকানিক আছে সবাই তার শিষ্য। সে যথেষ্ট পারদর্শী একজন মোটর মেকানিক ছিল। অসুস্থতায় তার চোখ দুটো অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখনো তিনি গাড়ির শব্দ শুনে বলে দিতে পারে গাড়ির কি সমস্যা। একজন ভালো মিস্ত্রি দেখে যেটা না পারে, সেটা শুনে করে ফেলে।

স্থানীয় বাসিন্দা শিবু মজুমদার বলেন, অন্ধ হয়েও হোসেন আলী নির্ভরযোগ্য এক মোটরসাইকেল মেকানিক হিসেবে মুখ। ক্লাচ প্লেট, ক্লাচ ডিস্ক, হেডলাইট, ইঞ্জিনের পিস্টন, টাইমিং চেনসহ মোটর সাইকেলের যাবতীয় কাজ নির্ভুলভাবে করে ফেলতে পারেন। মানুষ বিশ্বাস করে তার কাছ থেকে মোটরসাইকেল মেরামত করান।

হোসেন আলীর কাছে মোটরসাইকেল মেরামত করতে আসা ইমন শেখ বলেন, আমি অনেক দিন থেকেই তাকে দেখছি। তার কাছে মোটরসাইকেলের কাজ করতে আসি। তার কাজ দেখে বোঝা যায় না তিনি অন্ধ মানুষ। তার কাজ আসলেই দেখার মতো। তিন নিখুঁতভাবে গাড়ির কাজ করে দেন।

এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. শফিকুল আলম বলেন, হোসেন আলী দীর্ঘদিন যাবৎ মঠবাড়িয়াতে খুব দক্ষতার সঙ্গে মোটরসাইকেল মেরামত করে যাচ্ছেন। অসুস্থতার কারণে তিনি তার দৃষ্টি শক্তি হারান।

আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় নিয়ে এসেছি। তিনি নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়া ভবিষ্যতে যদি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা তার জন্য আসে আমরা অবশ্যই তাকে পৌঁছে দেব।

The post মঠবাড়িয়ায় শব্দ শুনে মোটরসাইকেল মেরামত করেন দৃষ্টিশক্তিহীন হোসেন আলী appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.

Tag :

মঠবাড়িয়ায় শব্দ শুনে মোটরসাইকেল মেরামত করেন দৃষ্টিশক্তিহীন হোসেন আলী

Update Time : 03:06:54 pm, Wednesday, 27 November 2024

মঠবাড়িয়া ((পিরোজপুর) প্রতিনিধি:

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলী। প্রায় দশ বছর আগে ব্রেন স্ট্রোকের পরে চোখে সমস্যা দেখা দেয় তার। চিকিৎসার অভাবে তার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যায়। অন্ধত্ব বরণ করে নিতে হয় তাকে।

তবে ৫০ বছর বয়সেও এই অন্ধত্ব দমাতে পারেনি হোসেন আলীকে। অন্ধ হয়েও শব্দ শুনেই সমস্যা বুঝে দিব্যি মেরামত করে ফেলেন মোটরসাইকেল। তার কাজ দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তিহীন।

এমনকি টাকা হাতে নিয়েই বুঝে ফেলতে পারেন কোনটা কত টাকার নোট। স্বল্প খরচে ভালো কাজ করেন বলেই মেকানিক হিসেবে এলাকায় রয়েছে তার বেশ কদর।

৯ বছর বয়সে ভাইয়ের দোকানে মোটরসাইকেল ও জেনারেটর মেরামতের হাতেখড়ি হোসেন আলীর। এরপর ধীরে ধীরে মেকানিকের কাজ রপ্ত করে ফেলেন তিনি। তখন থেকেই যন্ত্র চলার শব্দ শুনেই সমস্যাগুলো ধরে ফেলতেন এবং সেগুলো মেরামতে কাজ করতেন।

দশ বছর আগে তার ব্রেন স্ট্রোকের পরে চোখে সমস্যা দেখা দেয়। অর্থাভাবে করাতে পারেনি চিকিৎসা। ফলে হারাতে হয় দৃষ্টি শক্তি। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে তার পিছু হাঁটতে হয়নি।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া পৌরশহরের কে এম লতিফ সুপার মার্কেটে ছোট্ট একটি দোকান ভাড়া নিয়ে আবারও মেকানিকের কাজ করা শুরু করেন। কারো অনুদান কিংবা সাহায্যে নেননি। বছরে দুইবার চোখের সমস্যার জন্য ৩৫ হাজার টাকা করে এক একটি ইনজেকশন নিতে হতো তার। তিনটি নেওয়ার পরে আর নিতে পারেননি তিনি।

এদিকে স্ত্রী সালমা বেগমের একটি কিডনি নষ্ট। তার জন্যও করতে হয় ব্যয়বহুল চিকিৎসা। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে হোসেন আলীর পরিবার। সরকার থেকে প্রতি তিন মাস পর পর ২ হাজার ৫শ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও সেটা দিয়ে সংসার চলে না তার। নিজ জীবনের গল্পটা এভাবেই ঢাকা পোস্টকে জানাচ্ছিলেন অন্ধ মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলী।

হোসেন আলী বলেন, এখন আগের মতো আয় রোজগার নেই সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। দৈনিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করলেও কোনো কোনো দিন খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। এখন সরকার যদি সাহায্য করতেন আমি তা মাথা পেতে নিতাম।

মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলীর ছেলে মো. তুহিন বলেন, আমার বাবা ২০১৫ সালের শেষ দিকে ব্রেন স্ট্রোক করেন এরপর থেকে তিনি চোখে দেখেন না। আমার বাবা আমারও ওস্তাদ। কোনো কাজেই তিনি দমে থাকেনি।

যেকোনো কাজ তিনি শব্দ শুনে করতে পারেন। আমাদেরকেও বলেন এখানে এখানে সমস্যা, আমরা সেভাবে কাজ করি। সরকারের কাছে আমাদের একটাই আবেদন আমাদের আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো না যে আমরা বাবার চিকিৎসা করব।

প্রথমে টাকা পয়সা যা ছিল চিকিৎসায় শেষ হয়ে গেছে এখন সরকারের কাছে দাবি সরকার যদি আমাদেরকে কিছু সাহায্য করতো তবে আমরা তার চিকিৎসা করাতে পারতাম।

মঠবাড়িয়া পৌরশহরের কে এম লতিফ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. রিপন বলেন, আমি দীর্ঘদিন মোটরসাইকেল পার্টসের ব্যবসা করি। সেহেতু মোটরসাইকেল মেকানিক হোসেন আলীর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়।

হোসেন আলী ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে ঢাকা থেকে মঠবাড়িয়ায় আসে এখানে যতজন মেকানিক আছে সবাই তার শিষ্য। সে যথেষ্ট পারদর্শী একজন মোটর মেকানিক ছিল। অসুস্থতায় তার চোখ দুটো অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখনো তিনি গাড়ির শব্দ শুনে বলে দিতে পারে গাড়ির কি সমস্যা। একজন ভালো মিস্ত্রি দেখে যেটা না পারে, সেটা শুনে করে ফেলে।

স্থানীয় বাসিন্দা শিবু মজুমদার বলেন, অন্ধ হয়েও হোসেন আলী নির্ভরযোগ্য এক মোটরসাইকেল মেকানিক হিসেবে মুখ। ক্লাচ প্লেট, ক্লাচ ডিস্ক, হেডলাইট, ইঞ্জিনের পিস্টন, টাইমিং চেনসহ মোটর সাইকেলের যাবতীয় কাজ নির্ভুলভাবে করে ফেলতে পারেন। মানুষ বিশ্বাস করে তার কাছ থেকে মোটরসাইকেল মেরামত করান।

হোসেন আলীর কাছে মোটরসাইকেল মেরামত করতে আসা ইমন শেখ বলেন, আমি অনেক দিন থেকেই তাকে দেখছি। তার কাছে মোটরসাইকেলের কাজ করতে আসি। তার কাজ দেখে বোঝা যায় না তিনি অন্ধ মানুষ। তার কাজ আসলেই দেখার মতো। তিন নিখুঁতভাবে গাড়ির কাজ করে দেন।

এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. শফিকুল আলম বলেন, হোসেন আলী দীর্ঘদিন যাবৎ মঠবাড়িয়াতে খুব দক্ষতার সঙ্গে মোটরসাইকেল মেরামত করে যাচ্ছেন। অসুস্থতার কারণে তিনি তার দৃষ্টি শক্তি হারান।

আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় নিয়ে এসেছি। তিনি নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়া ভবিষ্যতে যদি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা তার জন্য আসে আমরা অবশ্যই তাকে পৌঁছে দেব।

The post মঠবাড়িয়ায় শব্দ শুনে মোটরসাইকেল মেরামত করেন দৃষ্টিশক্তিহীন হোসেন আলী appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.