খুলনার কয়রা উপজেলায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে রাতের আধারে পিচ ঢালাইয়ের কাজ করেছেন ঠিকাদারের লোকজন। প্রভাবশালী নেতার আস্থাভাজন লোক পরিচয় দিয়ে ভয় স্থানীয়দের বাঁধাও উপেক্ষা করেন তারা। কয়রা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরবর্তী আঠারো মাইল থেকে ঠান্ডা মিক্সার (পিচ ও পাথর) এনে কাজ করায় কাজের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া থেকে বাগালী ইউনিয়নের হোগলা অভিমুখী রাস্তা সংস্কার কাজের মেয়াদ শেষ হলেও বাকী রয়েছে প্রায় অর্ধেক কাজ। কাজে ধীরগতিসহ নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করার ব্যাপক অভিযোগ উঠে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ডব্লিউবিএম এ নিম্নমানের খোয়া ব্যবহার, হেজিং এ দুই নম্বর ইটের ব্যবহারসহ প্যারাসাইডিং তৈরিতে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়। এ বিষয়ে স্থানীয়রা বার বার প্রশাসনকে জানিয়েও সুফল পাননি। অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশ পায়। এরপরেও গুণগতমান বজায় না রেখে পিচ ঢালাই দেয়া হয়। কয়েকমাস কাজ বন্ধ রাখার পরে ১৭ ডিসেম্বর বিকালে কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু করেন। আঠারো মাইল থেকে পিচের মিশ্রণ আনা হয়। পিচের মিশ্রণ রাস্তায় দেওয়া শুরুর একপর্যায়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। এরই মধ্যে তিনটি গাড়ি ভর্তি পিচের মিশ্রণ ঠান্ডা হয়ে যায়। স্থানীয় কয়েকজন সেখানে যেয়ে ফের গরম করে মিশ্রণ ব্যবহারের কথা বললে তারা কর্ণপাত করেন নি। স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান ওইখানে উপস্থিত এলজিইডি অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আফজাল হোসেন এর কাছে কাজের মান বজায় রাখার বিষয়ে অনুরোধ করেন। তবে তিনি বিষয়টি আমলে নেননি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে স্থানীয় চেয়ারম্যান, সংবাদকর্মী, আইনজীবি ও স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উপজেলা প্রকৌশলী দারুল হুদা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাসকে অবহিত করেন। এরই মধ্যে ওই উপ-সহকারী প্রকৌশলী গুণগতমান ঠিক না থাকায় ঠিকাদারের লোকজনকে কাজ করতে নিষেধ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। কিন্তু পুনরায় কাজ করার চেষ্টা করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলী কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তবে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে ঠিকাদারের আস্থাভাজন কতিপয় ব্যক্তি এসে পুনরায় ঠান্ডা পিচের মিশ্রণ দিয়ে কাজ শুরু করেন। স্থানীয়রা ফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করলে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাঠানোর জন্য আশ্বাস্ত করেন। তবে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোন সদস্য ঘটনাস্থলে আসেননি। স্থানীয় সচেতনমহল উপজেলা প্রশাসনকে একাধিকবার অবহিত করেও ঠান্ডা পিচ দিয়ে কার্পেটিংয়ের কাজ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়।
কয়রা উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় কয়রা উপজেলার আরএন্ডএইচ দেয়াড়া থেকে হোগলার হাট জিসি ও গড়ইখালী জিসির চারশ’ মিটার রাস্তা সংস্কারের কাজের টেন্ডার পায় মেসার্স রওশনারা এন্টারপ্রাইজ নামে খুলনার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালে ১৬ অক্টোবর ওই প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্তে নোটিশ অব প্রসিউড প্রদান করা হয়। কাজটির প্রাক্কালিত মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ কোটি ৮৫ লাখ ৭ হাজার ৯২৫ টাকা। ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর কাজটি শুরু ও ২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কাজটি সমাপ্তির নিদের্শনা দেওয়া হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান জানান, ব্যবহারযোগ্য অনুপযুক্ত ঠান্ডা মিশ্রণ দিয়ে ঢালাইয়ের বিষয়ে তিনি উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে জানালে প্রথমে ব্যবস্থা নেননি। পরে চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। পরবর্তীতে কাজ বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে উনি (উপ-সহকারী প্রকৌশলী)চলে যান। তবে ঠিকাদারের লোকজন ব্যবহার অনুপযুক্ত সেই মিশ্রণ দিয়ে কার্পেটিং এর কাজ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা এড. ইয়াসিন বিন সদর বলেন, আমার বাড়ির পাশে রাতে কাজ করতে দেখে সেখানে যাই। ঠান্ডা মিশ্রণ দিয়ে কার্পেটিং করা হয়। এছাড়া যথাযথ বিটুমিন না দিয়ে সড়কের উপরে নামমাত্র বিটুমিন ছিটিয়ে দেয়া হয়। আমরা নিষেধ করলেও কর্ণপাত করেন নি ঠিকাদারের লোকজন।
স্থানীয় বাসিন্দা আফাজ পাড়, তৈয়েবুর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন জানান,
দীর্ঘদিন সড়কটির বিভিন্ন স্থান খুঁড়ে ফেলে রাখায় চলাচলে ব্যাপক সমস্যা হয়। সড়ক সংস্কারে অতি নিম্নমানের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। সেই খোয়া পরিবর্তন না করেই পিচ ঢালাই দেয়া হচ্ছে। পিচ ঢালাই দেওয়া বেশ কিছু অংশ ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তার দুই পাশে ঠিকমতো মাটি দেওয়া হয়নি। রাস্তাটির পাশের হেজিং এ নিম্নমানের ইট দেওয়া হয়।
তারা আরও বলেন, কয়রা উপজেলা প্রকৌশলীর নির্দেশনায় নিম্মমানের ইট অপসারণ করার পরেও আইওয়াস করে ফের ভিন্নস্থানে সেই একই ইট ও খোয়া ব্যবহার করা হয়। এরপরে পিচ ঢালাইও ঠিকমত করা হচ্ছে না। কাজ শেষ না হতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে অর্থ অপচয় করার দরকার ছিল না।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রওশনারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, খুলনা জেলা ছাত্র দলের নেতা রুবেল আমার ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে ঐ কাজটি করছেন। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি উপজেলা এলজিইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন।
সাব কন্ট্রাক্টর ও কাজের তদারককারী রুবেল বলেন, কিছু সমস্যার কারণে ঐ কাজটি দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ ছিল। দেশের পট-পরিবর্তনের পরে কাজটি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করতেছি। গতকাল কার্পেটিং এর সময় মেশিনের ত্রুটির কারণে পিচ দিতে দেরি হয়েছিল। কাজ ত্রুটিপূর্ণ হলে সমাধান করে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা প্রকৌশলী মো. দারুল হুদা বলেন, কার্পেটিং কাজের সময় উপ-সহকারী প্রকৌশলী আফজাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। অনুপযুক্ত পিচ দিতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন এবং কাজ বন্ধ রাখতে বলে চলে আসেন। পরে ওই ব্যবহার অনুপযুক্ত পিচের মিশ্রণ ফের দেওয়ার কথা এলাকাবাসী জানালে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেছিলাম। আমরা ত্রুটিপূর্ণ কাজ হলে তার বিল আটকিয়ে রাখবো। আর সাবকন্ট্রাক বিষয়ে তাদের সম্পৃক্ততার কথা তিনি অস্বীকার করেন।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, রাতে উপজেলা প্রকৌশলী ও স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরে কাজ বন্ধের ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। ঐ ওয়ার্ডের মেম্বার ও গ্রাম পুলিশের সহযোগিতায় কাজটি এখন বন্ধ রয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলীকে ত্রুটিপূর্ণ কার্পেটিং উঠিয়ে নতুন করে কার্পেটিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এএজে
The post কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে ঠান্ডা মিশ্রণ দিয়ে রাতে পিচ ঢালাই appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.