মোছাঃ হামিদা বেগম। স্বামী শেখ নাজমুল ইসলাম চা-পান বিক্রেতা। তবে মাঝেমধ্যে শ্রমিকের কাজও করেন। স্বামীর ক্ষুদ্র আয়ে দুই মেয়ের পড়াশুনা খরচসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার ঠিকমত চলে না। হতদরিদ্রদের জন্য ভিডব্লিউবি চক্রের মাসিক ৩০ কেজি চাল পাওয়ার আশায় ২০২৩ সালে আমাদী ইউনিয়ন পরিষদে যেয়ে আবেদন করেন। তবে তার আবেদন গৃহিত হয়নি বলে জানানো হয়। বেশ কয়েকবার আমাদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ জিয়াউর রহমান জুয়েল ও স্থানীয় ২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ আব্দুল আজিজ এর সাথে যোগাযোগ করেও কার্ড নিতে পারেননি। তার নামে ৩০ কেজি চালের কোন কার্ড হয়নি বলে তারা তখন হামিদাকে জানান। তবে স্বৈরাচারি আওয়ামী সরকার পতনের পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ভিডব্লিউবি চক্রের তালিকায় তার নাম রয়েছে। তবে তিনি কখনও চাল পাননি। হামিদা বলেন, ‘‘আমাদের খুব কষ্টে জীবন গেছে। সংসদ নির্বাচনের কয়দিন আগে ওদের (সন্তান) আব্বুরে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। তার কোন অপরাধ ছিল না। মিথ্যা নাশকতা মামলায় চার মাস জেল খাটে। ওই সময় মেয়েটা খুব অসুস্থ ছিল। তখন যদি এক বস্তা চাল পেতাম, মনে হয় বাচ্চা দুটোর একটু ভালো রাখতে পারতাম। সংসার চালাতে লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াইছি। এখনও দুইটি সন্তান নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছি।”
একই ওয়ার্ডের নারগীস মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার স্বামী প্রতিবন্ধী হওয়ায় তেমন কাজ করতে পারেন না। নারগীসের নামেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভিডব্লিউবি চক্রের একটি কার্ড রয়েছে। প্রতিমাসে চাল উত্তোলনও দেখানো হয়েছে। তবে নারগীস কোন চাল পাননি বলে অভিযোগ করেন। এমনিকে আবেদনের পরে তিনি মেম্বারের সাথে যোগাযোগ করলে তার নামে কার্ড হয়নি বলে জানানো হয়।
ফারজানা নামের এক স্বামী পরিত্যাক্ত নারীও কার্ড থাকতে চাল পাচ্ছেন না । আট বছরের এক সন্তান নিয়ে তিনি কষ্টে দিনতিপাত করতেন। আবেদন করার পরে একটি কার্ড পেলেও কখনও চাল উত্তোলন করতে পারেন নি। স্বামীর নির্যাতনে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে জীবিকার তাগিদে ফারজানা সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন।
শুধু হামিদা, নারগীস কিংবা ফারজানা নয় কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তালিকা অনুসন্ধানে এমন বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। যাদের নামে কার্ড হলেও তাদেরকে চাল না দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে স্থানীয় ইউপি সদস্য আত্মসাৎ করছেন কিংবা তার অনুসারি ব্যক্তিদের দিচ্ছেন বলে জানা যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৯ জন তালিকাভূক্ত হন। এরমধ্যে নাজমুন্নাহারের কার্ডের চাল তোলেন রহিমা খাতুন নামের একজন মহিলা, নারগীসের কার্ডের চাল নেন আখি বেগম নামের এক মহিলা, হামিদা বেগমের চাল নেন সোনিয়া বেগম, ফারজানার নামের কার্ডের চাল কে নেন এটা জানা যায়নি। এছাড়া ওই ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডের একাধিক প্রকৃত কার্ডধারীদের চাল না দিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ঘণিষ্ঠজনদের দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চালের কার্ডে প্রকৃত সুফলভোগীদের নাম লেখা থাকলেও সেটা কেটে দিয়ে অন্যদের নাম ঠিকানা লেখা হয়েছে। ১ নং, ৩ নং ও ৫ নং ওয়ার্ডের একাধিক প্রকৃত কার্ডধারীদের চাল দেয়া হয়না। তাদের কার্ড বাতিল করে নিজেদের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া একাধিক সরকারী চাকুরীজীবিসহ অধিক স্বচ্ছল পরিবার কার্ডের চাল পাচ্ছেন। ভিডব্লিউবি চক্রের তালিকাভূক্ত হতে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আঃ আজিজ সরদারের বিরুদ্ধে ১৮ নভেম্বর চাল আত্মসাৎ এর অভিযোগ তুলে একই ওয়ার্ডের হামিদা ও নারগীস নামের দুই জন হতদরিদ্র মহিলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। একমাস অতিবাহিত হলেও তাদের অভিযোগের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
হামিদার কার্ডের চাল উত্তোলনকারী সোনিয়া বেগম জানান, তিনিও আবেদন করেন। পরে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ তাকে ফোন দিয়ে একটি কার্ড দেয়। সেখান থেকে প্রতিমাসে ফোন করার পরে চাল নেন। অন্যের কার্ড কিনা সেটা তিনি জানেন না।
আমাদী ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল আজিজ বলেন, কার্ড বিতরণ করেন গ্রাম পুলিশ। সম্প্রতি বিষয়টি জানার পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ভুলে একজনের কার্ড অন্যজনকে দেয়া হয়। এটা জানার পরে প্রকৃত কার্ডধারীকে চালের মূল্য এনে দিতে চেয়েছি। তবে তারা নিতে চাচ্ছেন না। তবে অন্যগুলো কিভাবে কি হলো তিনি জানেন না।
এ বিষয়ে আমাদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জুয়েল বলেন, দুই জনের অভিযোগ সম্পর্কে জেনেছি। তাদের কার্ড ভুলে অন্য দুইজনের কাছে চলে যায়। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, বেশ কয়েকজন কার্ডধারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠায় তদন্ত সাপেক্ষ যথাযথ নিয়ম পালনের মাধ্যমে তাদের কার্ড বাতিল করে নতুনদের দেয়া হয়েছে। সেগুলো কর্তৃপক্ষ অবগত।
দুই জনের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের কাজ চলমান বলে জানান কয়রা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, এক মাস আগে দুইজন ভূক্তভোগী অভিযোগ করেন। বিষয়টি তদন্তের জন্য মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য অভিযোগের বিষয়েও তদন্ত সাপেক্ষ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খুলনা গেজেট/ টিএ
The post ভিডব্লিউবি চক্রের কার্ডধারীদের চাল বিতরণে অনিয়ম appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.