নগর প্রতিনিধি:
অযত্ন আর অবহেলায় পরিত্যাক্ত ভবনে পরিনত হয়েছে বরিশালের সবচেয়ে প্রাচীন পাবলিক লাইব্রেরিটি। প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতায় এখন লাইব্রেরি ভবনটি পরিনত চোর ও মাদকসেবিদের আস্তানায়। নেশার টাকা জোগারে লাইব্রেরির লোহার জানালা সহ বিভিন্ন জিনিস প্রতিদিন তুলে নিয়ে বিক্রি করছে এরা। এক সময়ে বরিশালের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদচারনায় মুখরিত এই পাবলিক লাইব্রেরিটি এখন ভূতের বাড়ী। ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরিটির দাপ্তরিক কাজ বন্ধ হয়ে যায় ১৩ বছর আগে। ৯ বছর আগে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয় দুষ্প্রাপ্য ১৪ হাজার বইয়ের সংগ্রহে থাকা এই গ্রন্থাগারটি। বর্তমানে দরজা-জানালার সাথে চুরি হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান বইও। অরক্ষিত লাইব্রেরি ভবনে এখনও কমপক্ষে ১০ হাজার বই রয়েছে যা রক্ষায় অতিদ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে জানান পাবলিক লাইব্রেরির অফিস সহায়ক শহীদ গাজী। তা না হলে কিছুদিনের মধ্যে এই লাইব্রেরির ভবনের ইটগুলো খুলে নেবে চোররা।
জানা গেছে, ব্রিটিশ সরকারের প্রচেষ্টায় ১৮৩৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি। এর ১৫ বছর পর ১৮৫০ সালে ‘পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট অব ইংল্যান্ড’ পাস করায় উপমহাদেশের বিভিন্নস্থানে স্থাপন করা হয় পাবলিক লাইব্রেরি। ওই অধ্যাদেশের অধীনে ১৮৫৪ সালে সদর রোড এনেক্স ভবনের পাশে ১৭ শতাংশ জমির ওপরে প্রতিষ্ঠা করা হয় বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। প্রতিষ্ঠার ১৩১ বছর পর ১৯৮৫ সালে লাইব্রেরিটি নগরীর বান্দ রোডে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ৫৬ শতাংশ জমির ওপর স্থাপন করা হয় একতলা পাবলিক লাইব্রেরি ভবন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সারাদিন বন্ধ থাকে লাইব্রেরি ভবনের প্রধান ফটক। লাইব্রেরি ভবনের চার পাশের জানালার কাচগুলো ভাঙ্গা। অনেক স্থানে জানালা ও গেটের লোহার অংশ, বিভিন্ন স্থানের গ্রীল ভেঙ্গে নিয়ে গেছে চোরেরা। ভবনের চার পাশের দেয়ালে হয়েছে আগাছা। ভবনের পেছনের অংশের ্েকটি সিড়ি পুরোই আগাছায় ঢেকে গেছে। জরাজীর্ণ ভবনের বিভিন্নস্থান থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। বইয়ের তাকগুলো তালাবদ্ধ। ভেতরে অধিকাংশ বই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটি মোটরসাইকেল গ্যারেজ হিসেবেও ব্যবহার করছেন। আর সন্ধ্যা হলেই স্থানীয় মাদকসেবিদের অভয়ারণ্যে পরিনত হচ্ছে এই লাইব্রেরি।
পাবলিক লাইব্রেরির অফিস সহায়ক পদে দায়িত্বরত শহীদ গাজী জানান, এই লাইব্রেরিতে প্রায় ৩০ বছর ধরে চাকরি করছেন। ১০ থেকে ১২ বছর আগেও দিনে দেড়-দুইশ লোক বই পড়তে আসতেন। এখন লাইব্রেরির মধ্যে সেই পরিবেশও নেই আর পাঠকও আসে না। এরআগে ৬ জন লোক এই লাইব্রেরিতে দাপ্তরিক কাজ করতেন। তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন চোর আর মাদকসেবি ছাড়া কেউ এখানে আসেনা। বরিশালের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদচারনায় এই লাইব্রেরির মুখরিত পরিবেশ দেখেছেন তিনি। অনেক দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান বই এখনও রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিটি বন্ধ হলেও সংরক্ষিত ছিল ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত। তবে ২০১৮ সালে লাইব্রেরি প্রাচীর ভেঙ্গে অর্ধেক জায়গা নিয়ে নেওয়া হয় কালেক্টরেট স্কুলের জন্য। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে ধ্বংস শুরু হয় লাইব্রেরির। বর্তমানে প্রতিদিন রাতে এই লাইব্রেরিতে চুরি হয়। দিনে অফিস সহায়ক শহীদ গাজী সামাল দিলেও রাতে আর পারছেন না। নিয়মানুযায়ী দায়িত্বরতদের পরিস্থিতির কথা বারবার জানিয়েও কোন লাভ হয়নি বলে অভিযোগ করেন শহীদ গাজী। তিনি বলেন, আমার মনে হয় না এটি আর চালু হবে। দিনে দিনে শেষ হয়ে গেলো একটি বিরাট ইতিহাস। তিনি এটি সংরক্ষনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানান।
লাইব্রেরিটির সদস্য এবং সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলার সভাপতি কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ঐতিহ্যবাহী পাবলিক লাইব্রেরিটি প্রথমে বিবির পুকুর পাড়ের এনেক্স ভবনে চলতো। সেই ভবনটি এখনো আছে। আবার স্থানান্তরিত ভবনও আছে। স্থানান্তরিত ভবনে কমপক্ষে ১৪ হাজার বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। কিন্তু অব্যবস্থাপনায় লাইব্রেরিটি এখন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত পড়ে আছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই পাবলিক লাইব্রেরিটি পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে বিশাল সংগ্রহশালা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ ২০১২ সালের দিকে ১১শ জন এই লাইব্রেরির সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে আজীবন সদস্য ৬শ জন আর সাধারণ সদস্য ৫শ জন। এনেক্স ভবনের পাশে ১৭ শতাংশের মধ্যে ৬ শতাংশ সিটি করপোরেশনের দখলে রয়েছে। এছাড়া লাইব্রেরি ভবনটি আরেকটি সংগঠন ইজারা নিয়ে ব্যবহার করছে। পদাধিকারবলে পাবলিক লাইব্রেরির সভাপতি হন জেলা প্রশাসক। সর্বশেষ ২০১২ সালে ৭ সদস্যের লাইব্রেরি পরিচালনায় এডহক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির আমিও সদস্য ছিলাম। আমাদের তখনো দাবি ছিল লাইব্রেরিটি পুনরায় চালু করা হোক। এখনো দাবি করছি, ১৭০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগারটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হোক। জাতীয় কবিতা পরিষদ বরিশালের সাবেক সভাপতি তপংকর চক্রবর্তী বলেন, ভারত বাংলায় প্রথম যে চারটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তারমধ্যে একটি বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরিটি একযুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। এটি দু:খজনক ব্যাপার। লাইব্রেরির সভাপতি জেলা প্রশাসক। এরআগে জেলা প্রশাসকদের কাছে আমরা অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা তেমন আগ্রহ দেখাননি। বর্তমান জেলা প্রশাসকের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। আমি মনে করি বরিশালের অন্য যে কোন উন্নয়ন কাজে হাত দেওয়ার আগে পাবলিক লাইব্রেরিটি চালু করা কর্তব্য।
এ বিষয়ে অতিরিক্তি জেলা প্রসাশক (রাজস্ব) মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, পাবলিক লাইব্রেরিটি বরিশালের অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি স্থাপনা। শিঘ্রই লাইব্রেরি পরিদর্শন করে এটি সংরক্ষনে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে জেলা প্রশাসন।
The post ১৭০ বছরের পুরনো পাবলিক লাইব্রেরি এখন চোর ও মাদকাসক্তদের আস্তানা ! appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.