বর্তমান সমাজের দুর্নীতি ও শোষণের তীব্র সমালোচনা করে জনপ্রিয় ইসলামি আলোচক মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী বলেছেন, “একদল মানুষ এতদিন ধরে দেশের সম্পদ লুটপাট করে খেয়েছে। আরেকদল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।” তার এ বক্তব্য উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে একধরনের সাড়া জাগিয়ে তোলে। তিনি সবাইকে অনৈতিকতা থেকে মুক্ত থেকে সৎ পথে চলার তাগিদ দেন।
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) যশোরের পুলেরহাটে আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত তাফসীরুল কুরআন মাহফিল তিনি একথা বলেন। তিনদিন ব্যাপী এ আয়োজনের শেষদিন মাহফিলে বয়ান দেন দেশসেরা দুই বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ ও ড. মিজানুর রহমান আজহারি। ইসলামের বার্তা ও ঐক্যের আহ্বান জানান ওই দুই বক্তা। আর তাদের বয়ান শুনতে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন যশোরের পুলেরহাটে আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজ মাঠে। রাত ১১টায় বয়ান শেষে তারা বাড়ি ফিরে যান।
এদিকে, আদ্বদীন ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ মাহফিলকে ঘিরে যশোর শহরের একাংশ, মুড়লি, টার্মিনাল, চাঁচড়া পুলেরহাট, নতুনহাট, ধর্মতলা, আরবপুর পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়। অনেকেই মাহফিল পর্যন্ত পৌছাতে না পেরে বাড়িতে ফিরে যান। এছাড়াও লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ১০ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
শুক্রবার বেলা ১১ টার মধ্যেই মুল স্টেজের সামনের মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জুম্মার নামাজের আগেই আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজের ভেতরে লোকারন্য হয়ে যায়। লাখো মানুষের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত হয় জুম্মার নামাজ। দুপুর তিনটা থেকে শুরু হয় আলোচনা ও পরিবেশনা। একের পর এক চলে বয়ান ও ইসলামি সঙ্গিত। রাত ৯টায় মিজানুর রহমান আজহারী মঞ্চে উঠেন।
তিনি বলেন,”আমাদের জনসংখ্যা একটি আশীর্বাদ হতে পারে, যদি আমরা তাদের যথাযথভাবে দক্ষ করে তুলতে পারি।” তিনি ইউনুস সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আমাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করার জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসংখ্যাকে দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, মানুষ আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কোরআনের কেন্দ্রীয় আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো মানুষ। “মানুষ ভালো হলে ফেরেশতাদের থেকেও ভালো, কিন্তু খারাপ হলে পশুর থেকেও খারাপ হয়। মানুষের জীবন শুরু হয় বিজয় দিয়ে, এবং সে মৃত্যুকে ছাড়া সব কিছু জয় করতে সক্ষম।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “যশোরের তরুণরা এবং দেশের জেনারেশন জেনজি নতুন করে দেশ সাজানোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে কোরআনের আলোকে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।”
তিনি আরও বলেন, “মুসলিমদের উচিত গণভবন, বঙ্গভবন, ডিসি অফিস এবং এসপি অফিসেও কালেমার পতাকা উড়ানোর স্বপ্ন দেখা।”
মানুষের ঈমানি শক্তির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “মানুষের কাছে আল্লাহ সমস্থ কিছু নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। যদি আমরা কোরআনের শিক্ষা মেনে চলি, তাহলে আমরা ব্যক্তি, পরিবার এবং পুরো দেশকে বদলে দিতে পারি।”
ড. আজহারি তার আলোচনায় ১০ জন বিশিষ্ট সাহাবীর উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, সাহাবীদের মধ্যে যে যার প্রতিভা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, “প্রত্যেকের প্রতিভা ও যোগ্যতা আল্লাহ প্রদত্ত। আমাদের উচিত এই প্রতিভাকে চিহ্নিত করে সঠিক কাজে নিয়োজিত করা।”
ড. আজহারির আলোচনার শেষে একটি বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। তিনি দেশ, জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি, উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য দোয়া করেন। মাহফিলে উপস্থিত লাখো মানুষ তার এই আলোচনায় মুগ্ধ হন এবং দোয়ার সময় আবেগে আপ্লুত হন। এসময় তিনি যশোরবাসীর উদ্দেশ্যে ছেলে সন্তান হলে তার নাম মুসহাব রাখার পরামর্শ দেন।
এরআগে মঞ্চে উঠেন আরেক বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ। তিনি সুরা হুজুরাতের ১৮টি আয়াতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য থেকে সাতটি বিশেষ বার্তা মুসলিম উম্মাহর জন্য তুলে ধরেন।
শায়খ আহমাদুল্লাহ সুরা হুজুরাতের আলোকে মুসলিম সমাজে শিষ্টাচার, সত্য যাচাই, ঐক্য এবং সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর জোর দেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, মুসলমানদের সব সময় ইসলামি শিষ্টাচার মেনে চলা উচিত। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সুন্দর আচরণ এবং ভদ্র ভাষায় কথা বলা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তথ্য যাচাই ছাড়া কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা বা গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকা জরুরি থাকার আহবান জানান।
শায়খ আহমাদুল্লাহ আরো বলেন, এই আয়াতগুলো শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য জীবন পরিচালনার একটি চমৎকার নির্দেশনা। এই শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলে মুসলিম উম্মাহ আরো শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠবে।
এরআগে মঞ্চে হাজির হন আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. শেখ মহিউদ্দিন। তিনি খুলনা বিভাগের মানুষের জন্য আগামি মার্চ পর্যন্ত ফ্রি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালুর ঘোষনা দেন। পরবর্তিতে মঞ্চে আসেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগে এ ধরণের আয়োজন করা সম্ভাব হয়নি। আমরা কল্পনা করিনি এমন আয়োজন করতে পারবো। ইসলাম ও কুরআন হাদিসের কথা এখন মানুষ নির্ভয়ে বলতে পারে।
এদিকে, মাহফিল ঘিরে পুরো যশোরে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। মাহফিলে আজ ১০ লাখের বেশী মুসল্লি সমবেত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। শুধুমাত্র যশোর নয়, আশপাশের জেলা মাগুরা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষিরা, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ দূরবর্তী স্থান থেকে বাস, ট্রাক ও ব্যক্তিগত যানবাহনে করে লাখো মানুষ মাহফিলে যোগ দেন। ভিড়ের কারণে মাহফিল মাঠে আসতে অনেকের সময় লেগেছে।
মাহফিল ঘিরে মুসল্লিদের মাঝে ঈমানি চেতনা ও উদ্দীপনা দেখা গেছে। যশোরের হাশিমপুর থেকে আসা ষাটোর্ধ্ব হাফিজ উদ্দিন জানান, তিনি বহুদিন ধরে আজহারি হুজুরকে সরাসরি দেখার স্বপ্ন দেখেছেন। নাতিকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি এসেছেন। মাগুরা থেকে আসা হাবিব জানান, সন্ধ্যায় চাচড়া মোড়ে পৌঁছালেও মাহফিলের মাঠে আসতে ভিড়ের কারণে দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। ঝিনাইদহ থেকে ইজিবাইক রিজার্ভ করে এসেছেন কুলসুম বেগম ও তার পরিবার। তারা জানান, ড. মিজানুর রহমান আজহারির আলোচনা শুনতে তাদের পুরো পরিবার মাহফিলে যোগ দিয়েছে।
চাচড়া মোড়ের ব্যবসায়ী নুর ইসলাম জানান, মাহফিল উপলক্ষে ব্যবসায়িক বিক্রি বেড়েছে, তবে যানজটের কারণে মুসল্লিদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
খুলনা গেজেট/এমএম/এএজে
The post একদল মানুষ এতদিন দেশের সম্পদ লুটপাট করে খেয়েছে, আরেকদল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত : আহজারি appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.