২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কুয়েট সংযোগ সড়কের আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় সময় বৃদ্ধি করা হয় ৩০ শে জুন পর্যন্ত। ৩০ জুনের মধ্যেও কাজ শেষ হয়নি।
এরপর কাজ শেষ করতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মাহবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিঃ কে কাজের বাস্তবায়নকারী সংস্থা খুলনা সিটি কর্পোরেশন ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ না হলে লাইসেন্স কালো তালিকাভুক্ত করা হবে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীর এমন সতর্কবাণীও কাজে আসেনি। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি।
কেসিসি থেকে জানা গেছে, ২৪ মাসে কাজের অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। মূল সড়কের কাজ এখনও শেষ হয়নি। শেষ হয়নি ড্রেন নির্মাণের কাজ। রোড ডিভাইডারের কাজ হয়েছে মাত্র ৩০০ মিটার। তৃতীয় দফায় ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু কাজে ধীর গতির কারণে ৩০ জুনের মধ্যেও প্রকল্পের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে এলাকাবাসীর।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি কেসিসি’র সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক কুয়েট এপ্রোচ সড়ক আধুনিকায়নের কাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের আওতায় খুলনা-যশোর মহাসড়কের ফুলবাড়িগেট হতে গভঃ ল্যাবরেটরী হাইস্কুল পর্যন্ত ১১৮৫ মিটার সড়ক প্রশস্তকরণ, সড়কের দু’পাশে ড্রেন নির্মাণ এবং পথচারীদের হাঁটার জন্য ফুটপাত নির্মিত হবে। সড়কটি হবে দুই লেনের। এজন্য সড়কের মাঝখানে ডিভাইডার নির্মিত হবে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৩ কোটি টাকা।
জানা যায়, কাজ শুরুর পর গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি দিয়ে যাতায়াতকারী যানবাহন চালক এবং পথচারীদের দুর্ভোগ শুরু হয়। যা গত দুই বছর ধরে চলমান রয়েছে। সড়কটিতে দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), খুলনা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ , উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (এইচএসটিটিআই), গভঃ ল্যাবরেটরী হাই স্কুল, খুলনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খানজাহান আলী থানা শিক্ষা অফিস, প্রতিভা প্রি ক্যাডেট স্কুল, আল হিরা মাদ্রাসাসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, প্যাথলজি ও দোকানপাট রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকসহ সাধারণ পথচারী প্রতিদিন সড়কটি দিয়ে গত দুই বছর ধরে যাতায়াতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। আর সামান্য বৃষ্টি হলেই এই দুর্ভোগের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হয়।
৬ মাস পূর্বে সড়কটি’র গভঃ ল্যাবরেটরী হাই স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কালভার্টের একাংশ নির্মাণ করে। বাকি অংশ নির্মিত না হওয়ায় বিদ্যালয়ের সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবক, যানবাহন চালকসহ পথচারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া প্রায়শই স্থানটিতে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়। কুয়েট পকেট গেটের সামনে দীর্ঘ ভোগান্তির পর কালভার্ট নির্মাণের কাজ শেষ হলেও দায়সারা ভাবে কালভার্টের উপরের ড্রেসিং কাজ করা হয়েছে। কালভার্টের উপর দিয়ে যানবাহন চলাচলে এখনও দুর্ভোগ হচ্ছে। ১ মাস পূর্বে ফুলবাড়িগেট থেকে কুয়েট প্রধান ফটক পর্যন্ত ৩০০ মিটার সড়কে বালি পাথরের মিক্সিংয়ের কারণে সড়কের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাথরের টুকরো। ফলস্রুতিতে যানবাহন চালক এবং পথচারীদের চলাচলের দুর্ভোগ হচ্ছে।
কুয়েট পকেট গেটের বাসিন্দা মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, সড়কটির কাজ শুরুর পর থেকে গত দুই বছরে আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। শুকনার সময় ধুলাবালি আর সামান্য বৃষ্টি হলে রাস্তায় কাঁদা মাটি কারণে সবার চলাচল করতে দুর্ভোগ হয়। দুই বছর পার হয়ে গেল এখনও ড্রেনের কাজই শেষ করতে পারল না । কাজের যে ধীরগতি তাতে এ কাজ কবে শেষ হবে আল্লাহ রব্বুল আলামিন জানেন।
সড়কের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোহাগ বলেন, গত দুই বছর ধরে ধুলাবালির কারণে বায়ু দূষণে অস্থির হয়ে গেছি। খোঁড়াখুঁড়ি সারা বছর লেগে আছে। কাজ শেষ না পর্যন্ত আমাদের স্বস্তিতে আসবে না।
টেস্ট মি খাবার হোটেলের মালিক আব্দুল্লাহ বলেন, সড়কটি সংস্কার কাজ না হয় গত দুই বছর ধরে আমরা ভোগান্তিতে আছি। সড়কটির আধুনিকায়ন কাজের ধীরগতি ও দুর্ভোগের কারণে কুয়েট কর্তৃপক্ষ একাধিকবার অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সিটি কর্পোরেশন এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার তাগিদেও কোন ফল হয়নি বলে অভিযোগ কুয়েট কর্তৃপক্ষের।
কুয়েটের প্রধান প্রকৌশলী এ, বি, এম মামুনুর রশিদ খুলনা গেজেটকে বলেন, খুলনা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক সিআরডিবি প্রজেক্ট-২ ‘র আওতায় ফুলবাড়িগেট থেকে কুয়েট মেইন গেট হয়ে ল্যাবরেটরী হাইস্কুল পর্যন্ত রাস্তা প্রশস্তকরণ, ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণের যে কার্যক্রম চলছে গত দুই বছরেও এটি শেষ না হওয়ায় যানবাহন এবং পথচারীদের চলাচলে দুর্ভোগ হচ্ছে। আমরা একাধিকবার কেসিসি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও ড্রেন এবং রাস্তার কাজ সমাপ্ত হয়নি। আগামী ১১ই জানুয়ারি কুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা। ২৪ হাজার ৫’শ স্টুডেন্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। স্টুডেন্টদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা আসবেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ হাজার লোকের সমাগম হব। সড়কের দূরাবস্থার কারণে সবার দুর্ভোগ হবে, কষ্ট হবে। বিগত দুইটা ভর্তি পরীক্ষায়ও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের অনুরোধ দ্রুত কাজটা শেষ করলে আমরা সবাই উপকৃত হব।
গভঃ ল্যাবরেটরী হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু হানিফ বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ৬ মাস ধরে এই দূরাবস্থা। ছেলেমেয়েদের অনেক সমস্যা হচ্ছে। স্কুলে সাড়ে ১১’শ ছাত্র ছাত্রী। ছুটির পর এবং স্কুলে প্রবেশের সময় প্রধান ফটকের সামনে প্রচুর ভিড় হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের ড্রেনের ভেতরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া বাইপাস রোডের সাথে সংযোগ থাকায় সড়কটি দিয়ে অনেক ভারি যানবাহন এবং ঢাকাগামী পরিবহন ও চলাচল করে। কালভার্টের সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের রোড ক্রস করতে হচ্ছে। দ দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। তৃতীয় শ্রেণীতে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নতুন ভর্তি হয়েছে। তাদের জন্য দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এ ব্যাপারে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা কেসিসি’র প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আধুনিকায়ন প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার (পিএম) বলেন, শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজে জটিলতা ছিল। ড্রেনের সীমানা নিয়ে জমির মালিকদের সাথে জটিলতা ছিল। সড়কের পাশের বৈদ্যুতিক পোল অপসারণ না হওয়ার কারণেও ড্রেন নির্মাণের কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। এছাড়া মামলা থাকায় ৯০ মিটার ড্রেনের কাজ এখনও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। গভঃ ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের সামনে বিদ্যুৎ লাইনের ট্রান্সমিটারের পোল অপসারণ না হওয়ায় কালভার্টের বাকি অংশের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শুরু করার পর গ্যাস লাইনের পাইপ বসানোর জন্য নতুন করে রাস্তা আবার খোঁড়াখুড়ি শুরু হয়।এতে করেও কাজে কিছুটা সময় ক্ষেপণ হয়।
এছাড়া সময় মতো বিল না পাওয়ার কারণেও কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। গত জুন মাসে বিল অনুমোদন হলেও বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সেই বিলের চেক পেয়েছি। প্রকল্পের বাকি কাজ আমরা খুব দ্রুততার সাথে শেষ করব ৩০ জুনের আগেই ইনশাআল্লাহ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে এলজিইডি ও কেসিসি’র যৌথ উদ্যোগে দ্বিতীয় নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সড়কটি’র আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা খুলনা সিটি কর্পোরেশন মাহবুব ব্রাদার্স প্রাঃ লিঃ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে সড়কটি আধুনিকায়ন এবং সৌন্দর্য বর্ধনের উন্নয়ন কাজের কার্যাদেশ প্রদান করে। কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো।
কার্যাদেশ অনুযায়ী খুলনা-যশোর মহাসড়কের ফুলবাড়িগেট হতে গভঃ ল্যাবরেটরি হাইস্কুল পর্যন্ত ১১৮৫ মিটার সড়ক প্রশান্তকরণ, ড্রেন, ফুটপাতে এবং ডিভাইডার নির্মাণ কাজের আধুনিকায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ২২ কোটি ৮৪ লাখ ৫৪ হাজার ২৩০ টাকা। গভারমেন্ট অফ বাংলাদেশ (জিওবি) এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) কাজটিতে অর্থায়ন করছে।
প্রকল্পের আওতায় খুলনা-যশোর মহাসড়কের কুয়েট রোডের প্রবেশদ্বারে আধুনিক ট্রাফিক আইল্যান্ড ও গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা থাকবে। কুয়েট রোডের প্রবেশদ্বার হবে ৬০ ফুট প্রশস্ত। ২ লেন বিশিষ্ট সড়কটির প্রত্যেক লেন প্রশস্ত হবে সাড়ে ২২ ফুট। ১ ফুট উঁচু করস হবে সড়কটি। সেই হিসেবে মূল এপ্রোচ সড়কটি প্রশস্ত হবে ৪৫ ফুট। সড়কের মাঝখানে রোড ডিভাইডারসহ দুই পাশে পানি নিষ্কাশনে থাকবে ৫ ফুট প্রশস্ত ড্রেন। ড্রেনের উপর দিয়ে জনসাধারণের চলাচলের জন্য ফুটপাতের ব্যবস্থা থাকবে। কুয়েট প্রধান ফটকের সামনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নির্মিত হবে দৃষ্টিনন্দন আইল্যান্ড।
খুলনা গেজেট/এইচ
The post ১২ মাসের কাজ ২৪ মাসেও শেষ হয়নি, কুয়েট সংযোগ সড়কে দুর্ভোগের শেষ কবে appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.