দেশের বিভিন্ন বাজারে গতকাল পুরনো আলু বিক্রি হয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নভেম্বর মাসে এমন চড়া দামের আলু বিক্রি হতে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সিন্ডিকেটের কারণেই এবার আলুর দামের এমন অবস্থা। বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারে মজুত থাকায় ও আমদানি জটিলতার কারণে এবার আলু দাম ভোগাচ্ছে ক্রেতাদের।
অবশ্য দাম নিয়ন্ত্রণে বা আলুর সরবরাহ স্বাভাবিক করতে নেই যথাযথ তদারকিও। আলুর মতো নিয়ন্ত্রণে আসেনি পেঁয়াজের দাম। দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি থাকা পেঁয়াজের দামও আকাশ ছোঁয়া।
সোমবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে ও বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগের মতো চড়া দামে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে। যা কৃষকের থেকে কেনা দামের চেয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ বেশি দামে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মজুতকারীরা কোনো কারণ ছাড়াই আলুর দাম বাড়িয়েছেন। কৃষক পর্যায় থেকে নামমাত্র মূল্যে আলু কিনে মজুত করে অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন থেকে এসব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব ঘটনা বার বার ঘটছে। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও বেশি সজাগ ও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তা-পর্যায় পর্যন্ত সব ধরনের তথ্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, সরকারের ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আমরা কিছুটা সন্দিহান। কারণ হচ্ছে, সরকার বলছিলো তারা বিভিন্ন চাঁদা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে, ব্যাংক ইন্টারেস্ট বাড়িয়েছে ও আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। তবে সাধারণ জনগণের কোনো সুবিধা পাননি। উল্টো ব্যবসায়ীরা এর ফায়দা লুটেছে।
জেলা প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যানুসারে, চলতি বছরের আলু উত্তোলন মৌসুমের শুরুতে কৃষক হাত থেকে পাইকারি দামে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হত ২৫ থেকে ২৮ টাকা। আর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হতো ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। সেই আলুর দাম বাড়তে বাড়তে ১৫ দিন আগেও খুচরা বাজারে ৬০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হয়েছে। অথচ গতকাল সোমবার খুচরা বাজারে ৮০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে মতে, জেলার হিমাগারগুলোতে এখনও ৩৬ হাজার মেট্রিক টনের বেশি আলু মজুদ রয়েছে। হাতে গোনা বড় ব্যবসায়ীদের হাতেই আলু মজুদ রয়েছে। আর ওই সিন্ডিকেটই আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও চড়া দামেই আলু কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। এজন্য সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারাকেই দোষারোপ করেছেন পাইকাররা। একই সঙ্গে ঢিলেঢালা বাজার তদারকিকেও দায়ী করেছেন তারা।
জেলার শহরের প্রধান বাজারে সবজি বিক্রেতারা মূল্য তালিকায় আলুর কেজি ৭০ টাকা উল্লেখ করলেও বিক্রি করছেন ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। সোমবার সকালে এ বাজারের ক্রেতা মঈনউদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি এক কেজি কিনেছেন ৭৫ টাকায়। আবার একই বাজারের অপর ক্রেতা জসিম মিয়া জানান, তিনি কেজিতে ৮০ টাকা দরে ২ কেজি আলু কিনেছেন।
শহরের দেওভোগ বাজারের ক্রেতা জাকির হোসেন জানান, একই দিন সকালে তিনি ওই বাজার থেকে কেজি প্রতি ৮০ টাকা দরে আলু কিনেছেন। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকেই তারা ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা কেজিতে আলু কিনছেন। এরমধ্যে ভালো ও খারাপ দুই ধরনের আলু রয়েছে। ক্রেতা যখন আলু নেন, তখন বেছে বেছে ভালো আলুই ব্যাগে ভরেন। এতে খারাপ আলু গুলো আর বিক্রি করা যায়নি। তাই ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি না করলে লাভ হবে না।
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. সামির হোসাইন সিয়াম বলেন, যারা আলু মজুদ করেছেন, তারাই ফোনে ফোনে দাম নির্ধারণ করছেন। তাদের নির্ধারিত দামেই সারাদেশে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এতে বাজারে বেড়েছে দাম।
এদিকে দিনাজপুরের হাকিমপুর প্রতিনিধি জানান, আলু ও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পণ্য দুটির রপ্তানি স্লট বুকিং বন্ধ রেখেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর ফলে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আলু ও পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। আমদানি বন্ধের ফলে পেঁয়াজের দাম না বাড়লেও আলুর দাম কেজিতে ৭ থেকে ১০টাকা করে বেড়েছে।
গত রবিবার দুপুর থেকেই পেঁয়াজ ও আলুর স্লট বুকিং বন্ধ করে দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গতকাল সোমবার বিকেল ৩টায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্লট বুকিং বন্ধ ছিল। গত শনিবার বন্দরে আমদানিকৃত লাল আলু ৫৬ থেকে ৫৭টাকা বিক্রি হয়েছিল যা রবিবার আমদানি জটিলতা বন্ধের খবরে দাম বেড়ে ৬৫ টাকায় উঠে যায়। এছাড়া সাদা আলু শনিবার ৫০টাকা বিক্রি হলেও রবিবার তা ৬০ টাকায় উঠে যায়।
ভারতের হিলি সিআ্যন্ডএফ এজেন্ট অনিল সরকার বলেন, পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে অনলাইনে ট্রাকের জন্য স্লট বুকিং নিতে হয়। এর পরেই সেই পণ্যের টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশে গতকাল দুপুর থেকে পেঁয়াজ ও আলুর স্লট বুকিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভারতের বালুরঘাটে ড্রিস্টিক ম্যাজিস্ট্রেট এর সঙ্গে বৈঠক চলছে। বৈঠক শেষ হলে বোঝা যাবে তবে আজ না হলেও কাল হবেই সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় এতে কোন সন্দেহ নেই।
ভারতীয় রপ্তানিকারক রাম কৃষ্ণ দাস বলেন, আমি ভারত থেকে বাংলাদেশে আলু রফতানি করি। অন্যান্য দিনের মত রবিবার আমি আলু রপ্তানি করেছি কিন্তু দুপুরে শুনতে পারলাম যে আলু ও পেঁয়াজের স্লট বুকিং বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এতে আমরা রপ্তানিকারকরাও অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ে গিয়েছি। ভারতের উত্তর প্রদেশ পাঞ্জাব হরিয়ানা এসব অঞ্চল থেকে আলু আসছে সেসব আলু বোঝাই ট্রাকগুলো রাস্তায় রয়েছে। এখন এই অবস্থায় এসব আটকে গেলে আমরা আলু পচে নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়ে যাবো।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলছে, তাদের রাজ্যে উৎপাদিত আলু ও পেঁয়াজ বিদেশে রপ্তানির ফলে বাজারে পণ্য দুটির দাম বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে এই স্লট বুকিং বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
হিলি স্থলবন্দরের আলু আমদানিকারক মোস্তফা হোসেন বলেন, বাজারে দেশীয় আলুর সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছেই। যার কারণে ভারত থেকে আলু আমদানি করা হচ্ছিলো। এখন হঠাৎ করে যদি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তো আমরা ক্ষতির মুখে পড়ে যাবো। আলুর দামও বেড়ে যাবে।
হিলি স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই আলু ও পেঁয়াজ আমদানি যেমন অব্যাহত ছিল তেমনি আমদানির পরিমাণ বাড়তির দিকে ছিল। গতকাল রবিবার বন্দর দিয়ে ৭২টি ট্রাকে ২ হাজার ৩৯ টন আলু আমদানি হয়েছিল। সোমবার তা অনেক কমেছে। সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাত্র ১ ট্রাক আলু আমদানি হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এইচ
The post সিন্ডিকেটের কবজায় আলুর বাজার appeared first on খুলনা গেজেট | সবার আগে সঠিক খবর.