বরগুনা প্রতিনিধি:
বরগুনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম গত ৫ আগস্টের পর থেকে তুলনামূলকভাবে বাড়লেও কমেনি দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য। তবে ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে সেবাপ্রার্থীদের আরও সচেতন হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বরগুনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আলী আশরাফ। এদিকে পাসপোর্ট অফিসকে দালালমুক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে বরগুনা জেলা প্রশাসন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের পটপরিবর্তনের পর এই অফিসের সেবার মান কিছুটা বেড়েছে। এর মধ্যে অফিসে ঢুকতে হলে রেজিস্টারে নিবন্ধন করা, পাসপোর্ট আবেদনের জন্য বিভিন্ন পরামর্শমূলক ফেস্টুন, সুশৃঙ্খলভাবে আবেদন গ্রহণ ও পাসপোর্ট বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা চোখে পড়ে। এ ছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের পরামর্শের জন্যও রেজিস্টার খোলা হয়েছে।
এত উদ্যোগের পরও আবেদনকারীরা অভিযোগ করেছেন, এসবের আড়ালেও দালালদের নির্ধারিত চ্যানেল ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন করলেই আবেদনপত্রে খুঁটিনাটি ভুল ধরতে শুরু করেন অফিসের আবেদনগ্রহণকারী সাবিনা ইয়াসমিন। আবেদন বাতিল করে আবার নতুন আবেদন করার পরামর্শ দিয়ে অফিসের সামনে, জেনারেল হাসপাতালের মোড়ে কিংবা বাজারের নির্দিষ্ট করা কিছু কম্পিউটারের দোকানে যেতে বলা হয় তাদের।
এমন পরামর্শে যারা কম্পিউটার দোকান বা দালালের সঙ্গে চুক্তি করছেন, তাদের অতিরিক্ত ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। অনেক সময় জরুরি পাসপোর্ট করতে গিয়ে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা দালালরা নিলেও নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট পাচ্ছেন না অনেক সেবাগ্রহীতা। ফলে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় তাদের।
তবে আবেদনকারীদের মধ্যে যারা একটু সচেতন, তারা ভবনের দোতলায় সুপারিন্টেন্ডেন্ট শরিফুল ইসলাম অথবা সহকারী পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তাদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতেও দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরগুনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ৫০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে বেশিরভাগ আবেদন জমা হয় ‘ঘুষ চ্যানেলে’। আবেদনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ন্যূনতম ঘুষ নেয় কম্পিউটারের দোকানের আড়ালে থাকা দালালরা। এ হিসাবে দৈনিক ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। ফলে মাসে ১৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পাসপোর্টে তথ্য সংশোধনের ওপর বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপের কারণে এসব ঘুষ-বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নাম, বাবা-মায়ের নাম এবং জন্মতারিখ সংশোধনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব বিষয়ে ঘুষের রেট খুবই চড়া। তবে দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পেতে অনেকে দালালদের কাছে ধরনা দেন। নাম অথবা জন্মতারিখ সংশোধনে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে আসে, প্রতিটি আবেদনে ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন দিয়ে পাঠালেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই আবেদন জমা হয়ে যায়। ঘুষের টাকা না দিলে চিহ্ন পাওয়া যায় না। আর চিহ্ন সম্পর্কে অবগত আছেন অফিসের আবেদনগ্রহণকারী।
সদর উপজেলার পরিরখাল এলাকার আবদুর রহমান বলেন, আমি ২৬ বছর ধরে প্রবাসে থাকি। আমার সব কাগজপত্র সঠিক থাকার পরও নির্বাচন অফিসের অনলাইন যাচাইপত্র দেখতে চান আবেদনগ্রহণকারী। সঙ্গে সঙ্গে আমি নির্বাচন কমিশনের সিলসহ অনলাইন যাচাইপত্র দেখালেও আমার আবেদনটি জমা নেননি। পরে আমি সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে দেখা করে আমার আবেদনপত্র ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখাই। তিনি আবেদনটি যাচাই করে জমা নিতে বলার পরই আমার আবেদন জমা হয়। তবে বাইরে অ্যাম্বাসিতে এমন ভোগান্তি পেতে হয় না।
পাসপোর্ট অফিসের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তি। কী সমস্যা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, আমি আমার ছেলের পাসপোর্ট নিতে এসেছিলাম। আমার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে আসতে বলা হয়। আনার পর আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গেও মোবাইল ফোনে কথা বলেন তারা। তার পরও আমার ছেলের পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি। এখন আবার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে বলে জানান।
রাকিব নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, আমি দালালের মাধ্যমে যাইনি, তাই আমাকে এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন কাগজের কথা বলে হয়রানি করা হচ্ছে। আজ সব কাগজ নিয়ে আসার পর বলা হচ্ছে আমার বিয়ের কাবিননামা আনতে হবে। দেশে পরিবর্তন এসেছে কিন্তু এই অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
দালালের মাধ্যমে আসা আবেদনকারীরা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মুখ খুলতে রাজি না হলেও, আশপাশের চায়ের দোকানগুলোতে বসে আবেদনপ্রতি ঘুষ লেনদেনের কথা আলোচনা করতে শোনা গেছে।
আরেক আবেদনকারী রিমন জানান, আমি অনলাইনে আবেদন করে কাউন্টারে জমা দিলে আমাকে নির্বাচন অফিস থেকে ভোটার তথ্য যাচাইয়ের অনলাইন কপি নিয়ে আসতে বলে। আমি ভোটার তথ্য যাচাইয়ের কাগজ নিয়ে আসার পর আবার বিদ্যুৎ বিলের কাগজ নিয়ে আসতে বলে, কিন্তু কাউন্টার থেকে একসঙ্গে সবকিছু বলা হয় না। পরে আমি সুপারের কাছে গেলে তিনি আবেদন জমা নিতে নির্দেশ দেন।
একাধিক কম্পিউটার ব্যবসায়ী বলেন, পাসপোর্টের আবেদন ফরম বর্তমানে অনলাইনে পূরণ করতে হয়। ফরম পূরণ করার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকা জমা নেয়। টাকা জমা দিয়ে ঘুষ না দিয়ে কেউ অফিসে গেলে পড়তে হয় ভোগান্তিতে। মা-বাবার আইডি কার্ডের সঙ্গে আবেদনকারীর আইডি কার্ডে অক্ষর কিংবা যতি চিহ্নের মিল না থাকলেই চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় আবেদনকারীকে।
তিনি আরও বলেন, সবকিছু মিল থাকলেও সর্বশেষ ফরমে টাকা জমা দেওয়ার তথ্য পূরণ করতে হবে বলে ফেরত পাঠায়। কিন্তু অনলাইনে আবেদন করতে টাকা জমার তথ্য পূরণের কোনো অপশন নেই। ফরম ডাউনলোড করলে পিডিএফ ফাইলের তৃতীয় পৃষ্ঠায় টাকা জমা দেওয়ার তথ্য চাহিত ছক থাকে। এভাবে নানা কারণ দেখিয়ে আবেদনকারীকে হয়রানি করা হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে তার আবেদন ফরম জমা নিলেও পড়তে হয় বিভিন্ন ঝামেলায়। আবেদন ফরম জমা রেখে ফেলে রাখা হয়। কোনো কাজ করা হয় না।
এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আলী আশরাফ বলেন, আমাদের অফিসের বাউন্ডারিতে কোনো দালাল ঢুকতে পারে না। মানুষ একটু সচেতন হলেই সেবাপ্রার্থী আবেদনকারীদের ভোগান্তি থাকবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, আমি জরুরি কাজে একটু বাইরে যাচ্ছি। সেখান থেকে ফিরে পাসপোর্ট অফিস দালালমুক্ত করার পাশাপাশি কর্মকর্তাদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
The post বরগুনায় পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য, ভোগান্তিতে সেবাপ্রার্থীরা appeared first on Amader Barisal – First online Newspaper of Greater Barisal – Stay with Barisal 24×7.